রোহান রাজিব: দেশের ব্যাংকগুলোয় গ্রামীণ মানুষের ব্যাংক আমানতে ধস নেমেছে। চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) প্রায় ৯৯ হাজার কোটি টাকার আমানত কমেছে। যেখানে আগের প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি বেড়েছিল। এ সময়ে দেশের আট বিভাগের মধ্যে ছয়টিতেই গ্রামের আমানত কমেছে। গ্রামীণ আমানত কমার দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে ঢাকা বিভাগ। তবে একই সময় প্রায় সব বিভাগে শহরের আমানত উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়ায় সার্বিক ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে।
গতকাল সোমবার প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শিডিউলড ব্যাংকস স্ট্যাটিসটিকসে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে রেকর্ড মূল্যস্ফীতি পার করছে বাংলাদেশ। দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। সবচেয়ে বেশি হিমশিম খাচ্ছে গ্রামীণ পর্যায়ের মানুষ। পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যাংকে থাকা সঞ্চয়ও ভেঙে ফেলতে হচ্ছে। আবার গ্রামীণ মানুষ কাজের জন্য বিদেশে যাচ্ছে বেশি। ডলারের দর বৃদ্ধির কারণে তাদের আগের তুলনায় বিদেশে নিয়ে যাওয়া ডলার কেনার খরচ বেড়েছে। এছাড়া ওই সময়ে ধানের উৎপাদন মৌসুম ছিল। উৎপাদনের কারণে মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে খরচ করেছে। যার কারণে তৃতীয় প্রান্তিকে গ্রামীণ মানুষের ব্যাংক আমানত কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতে মোট আমানত ছিল ১৬ লাখ ৮৭ হাজার ২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা ছিল গ্রামীণ আমানত। কিন্তু সেপ্টেম্বর শেষে গ্রামীণ আমানত কমে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮৭০ কোটি টাকায়। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকগুলোর গ্রামীণ মানুষের আমানত কমেছে ৯৮ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা বা ২৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত তিন মাসে দেশের আট বিভাগের মধ্যে ছয়টিতে গ্রামীণ আমানত কমেছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে কমেছে সর্বোচ্চ ৪৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগে কমেছে ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ। সিলেট বিভাগে কমেছে ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এছাড়া বরিশাল বিভাগে ৮ দশমিক ৯২ শতাংশ, রাজশাহীতে ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ ও ময়মনসিংহ বিভাগে ১ দশমিক ৯০ শতাংশ কমেছে। খুলনা ও রংপুর বিভাগে বেড়েছে যথাক্রমে শূন্য দশমিক ৯২ ও শূন্য দশমিক ৪২ শতাংশ। তবে একই সময়ে খুলনা বাদে অন্য ৭টি বিভাগে শহরের আমানত উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেড়েছে। খুলনা শহরে আমানত কমেছে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি আনিস এ খান শেয়ার বিজকে বলেন, প্রথমত, মূল্যস্ফীতির কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। ১০০ টাকার জিনিস ১২০ টাকায় কিনছে। এই বাড়তি ২০ টাকা সঞ্চয় থেকে খরচ করছে। দ্বিতীয়ত, বিদেশে বেশিরভাগ মানুষ গ্রাম থেকেই যাচ্ছে। তারা বাইরে যাওয়ার জন্য মার্কেট থেকে ডলার কিনে। যেখানে আগে ডলার ৯০ টাকায় কিনতো, সেটা এখন ১২৪ টাকায় কিনছে। এখানেও বাড়তি খরচ হচ্ছে। তৃতীয়ত, মানুষ এখন টাকা তুলে হাতে রাখছে। কারণ সামনে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘাত চলছে। তাই গ্রামীণ মানুষ ভয়ে টাকা হাতে রাখছে। এই তিন কারণে গ্রামীণ মানুষের আমানত কমছে।
অন্যদিকে শহরের আমানত বেড়েছে, যার কারণে সার্বিকভাবে সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে আমানত বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে আগের তুলনায় অনেক কম।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুন শেষে শহরে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ২৮ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা। আর সেপ্টেম্বরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৫৩ হাজার ২৬৫ কোটি টাকায়। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে শহরে আমানত বেড়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। ফলে সেপ্টেম্বর শেষে সার্বিক ব্যাংক খাতের আমানত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ১৩ হাজার ১৩৫ কোটি টাকায়। জুন শেষে যা ছিল ১৬ লাখ ৮৭ হাজার ২৫ কোটি টাকা। তিন মাসে আমানত বেড়েছে ২৬ হাজার ১১০ কোটি টাকা বা ১ দশমিক ৫৫ শতাংশ। তার আগের প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিচুউয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, গ্রামীণ মানুষের সঞ্চয় করার সক্ষমতা কম। কারণ তাদের ওই পর্যায়ের আয় নেই। রেকর্ড মূল্যস্ফীতির কারণে এসব মানুষ ভুগছে। তাই তারা দৈনন্দিন জীবনযাপন চালানোর জন্য আমানত ভেঙে খাচ্ছে। এছাড়া তাদের আয় করার অন্য উপায় নেই। কারণ ইকোনমি মুভ করছে না। আবার শহরের অনেক লোক বাড়ি চলে গেছে, যার কারণে গ্রামীণ মানুষের আমানতের ওপর এ প্রভাব পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, মূলস্ফীতির কারণে গ্রামীণ মানুষের আমানতের ওপর প্রভাব পড়তে পারে। আবার এ প্রান্তিকে সার কেনা ও ধান উৎপাদনের কারণে মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে খরচ করেছে, যার কারণে আমানত কমতে পারে। আগের প্রান্তিকে বাড়ছিল, কারণ হারভেস্টিং শেষ হয়েছিল, তখন ধান বিক্রি করে ব্যাংকে টাকা রাখছিল। তাই ওই সময়ে আমানত বেড়েছিল।