নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে আমদানির চেয়ে রপ্তানি আয় কম হওয়ায় অর্থবছরের শুরু থেকে বড় অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টম্বর) বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭৫৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার। একই সময়ে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের ঘাটতি ৩৬১ কোটি ডলার। গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এক হাজার ৯৩৪ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। এর বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে এক হাজার ১৮০ কোটি ডলারের পণ্য। এতে ৭৫৪ কোটি ৮০ লাখ ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১০৩ টাকা ধরে) এর পরিমাণ ৭৭ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি, বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী ও আশানুরূপ রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় না থাকায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়ছে বাংলাদেশ।
তারা বলেন, আমদানি ব্যয় কমাতে এরই মধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিলাসবহুল পণ্যে শতভাগ পর্যন্ত এলসি মার্জিনের হার নির্ধারণের পাশাপাশি ঋণ বন্ধ করা হয়েছে। এছাড়া যেকোনো পণ্যে ৩০ লাখ ডলারের বেশি অঙ্কের এলসি খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতে হচ্ছে। ব্যাংকের পাশাপাশি মানিচেঞ্জারে অভিযান চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডিজিটাল হুন্ডি বন্ধেও বিভিন্ন পদক্ষেপ চলমান। এ রকম বিভিন্ন উদ্যোগের প্রভাবে সেপ্টেম্বরে এলসি খোলা কমেছে। নানা পণ্য আমদানির জন্য মোট ৫৭০ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়, আগের মাস আগস্টের তুলনায় যা ৬৩ কোটি ডলার বা ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ কম। এলসি নিষ্পত্তি আগের মাসের চেয়ে ১৮ শতাংশের বেশি কমে ৬০০ কোটি ডলারে নেমেছে।
আলোচিত সময়ে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতিও বেড়েছে। সেপ্টেম্বর শেষে সেবা খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে ২২৩ কোটি ডলার। অন্যদিকে সেবা খাতে দেশের ব্যয় হয়েছে ৩৩৩ কোটি ডলার। এ খাতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১১০ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ৬০ কোটি ডলার।
চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। সেই হিসেবে উন্নয়নশীল দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা ভালো। কিন্তু দেশে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স এখন ঋণাত্মক হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বর শেষে এ ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৬১ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরে একই সময়ে এ ঘাটতি ছিল ২৫৪ কোটি ডলার।
সামগ্রিক লেনদেনেও (ওভারঅল ব্যালান্স) বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। সেপ্টেম্বর শেষে সামগ্রিক লেনদেনের (ঋণাত্মক) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৪৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এ সূচকটি আগের বছরের একই সময়ে ৮১ কোটি ডলার ঘাটতি ছিল।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম তিনি মাসে ৫৬৭ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। আগের বছর একই সময়ে পাঠিয়েছিলেন ৫৪০ কোটি ডলার। ফলে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ শতাংশ।
অন্যদিকে দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) পরিমাণ বাড়ছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর ৯০ কোটি ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়ে ১১৫ কোটি ডলারে উঠেছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে সরাসরি মোট যে বিদেশি বিনিয়োগ আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ নিয়ে যাওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকে তাকে নিট এফডিআই বলা হয়। আলোচিত সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ বেড়ে ৪৫ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত বছর একই সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৩৭ কোটি ডলার।
তকোন পণ্য আমদানিতে কত ব্যয় : কোন পণ্য আমদানিতে কেমন খরচ হয়েছে সে তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে গম আমদানি ব্যয় ৩২ কোটি ডলার হয়েছে। চাল আমদানি ৮ কোটি ২৫ লাখ ডলার। ভোগ্যপণ্য আমদানিতে সামগ্রিকভাবে ১৩৪ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে ভোজ্যতেলে ৯২ কোটি, ডালে ১২ কোটি, চিনিতে ১২ কোটি এবং দুধ ও ক্রিমে ৮ কোটি ৫৬ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ব্যয় ১৩০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। অন্য মূলধনি পণ্যে ২২৯ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে।
উল্লেখ্য, করোনা সংক্রমণ কমায় বিশ্বব্যাপী যখন চাহিদা বাড়ছিল, ঠিক সে সময়ে শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এর প্রভাবে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। যে কারণে গত অর্থবছরে আমদানিতে খরচ হয়েছে ৮২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। একই সময়ে যেখানে রপ্তানি আয় হয়েছে ৪৯ বিলিয়ন ডলার। এতে করে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ওপরে উঠেছে। আর দেশের চলতি হিসাবে রেকর্ড প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি হয়েছে, যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। সব মিলিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে সামগ্রিক লেনদেনে ঘাটতি হয়েছে ৫ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছর যেখানে উদ্বৃত্ত ছিল ৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার।