তিন মাসে শিল্পঋণে খেলাপি বেড়েছে ৫৭৭১ কোটি টাকা

রোহান রাজিব: ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের বেশিরভাগ যায় শিল্প খাতে। অন্যান্য খাতের মতো এ শিল্প খাতের ঋণেও খেলাপি হয়ে পড়ছে। চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (্এপ্রিল-জুন) এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা বা ১১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সঠিকভাবে ঋণ বিতরণ না করায় তা আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। বেশিরভাগ ঋণ বিতরণ হয়ে থাকে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে। দেখা যাচ্ছে, এসব প্রতিষ্ঠানই বারবার ঋণ পাচ্ছে। এর ফলে শিল্পে ঋণ কেলেঙ্কারিসহ নানা অনিয়ম সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া ব্যাংকগুলো বেশি মুনাফার লাভে যাছাই-বাছাই ছাড়াই এসব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিচ্ছে। তাই আদায়ের চেয়ে খেলাপি হচ্ছে বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালের জুন শেষে শিল্পঋণে খেলাপির পরিমাণ ৫৮ হাজার ১৪৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, যা গত মার্চে ছিল ৫২ হাজার ৩৭২ কোটি ২৫ টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা বা ১১ শতাংশ। 

প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে শিল্প খাতে খেলাপি ৫৮ হাজার ১৪৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, যা ব্যাংকিং খাতের মোট খেলাপির ৪৬ দশমিক ৪১ শতাংশই শিল্প খাতের অবদান।

তথ্যে অনুযায়ী, শিল্প খাতের খেলাপি ঋণের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে রয়েছে ৪৭ হাজার ৬১৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ১০ হাজার ৫২৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। বাণিজ্যিক ব্যাংগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে। বেসরকারি ব্যাংকে ১৯ হাজার ৬৮৯ কোটি ১৪ লাখ বা ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এসব ব্যাংকের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। এরপর রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকে খেলাপি ১৯ হাজার ৫২৯ কোটি ২৬ লাখ, যা বিতরণকৃত ঋণের ২২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। তাদের ঋণ স্থিতি ৮৬ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকে ১ হাজার ১০১ কোটি ১৩ লাখ টাকা খেলাপি বা ২৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। এসব ব্যাংকের ঋণ স্থিতি ৪ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংকে ১ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা খেলাপি বা ২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজার ২০৭ কোটি টাকা। এছাড়া ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোতে ৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা খেলাপি বা ৭ দশমিক ৫১ শতাংশ। এ সময়ে ব্যাংকগুলোতে ঋণ স্থিতি ১ লাখ ৪৮ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে এক লাখ ২৮ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা, যা তিন মাস আগে ছিল ১ লাখ ২১ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বা ৫ দশমিক ৫১ শতাংশ।

এদিকে শিল্পঋণ বিতরণ বাড়লেও আদায়ের হারের অবস্থা নাজুক। চলতি বছরের জুন শেষে আদায় কমেছে ১৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত শিল্প খাতে ঋণ আদায় হয়েছে ৮৮ হাজার ২৩১ কোটি টাকা, যা তিন মাস আগে ছিল ১  লাখ ১ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে শিল্প খাতে ঋণ আদায় কমেছে ১৩ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা বা ১৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিতরণ করা শিল্পঋণের মধ্যে ছয় লাখ ৬৯ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। এ অঙ্ক তিন মাস আগের তুলনায় ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেশি। চলতি বছরের মার্চ শেষে বকেয়া ছিল ছয় লাখ ২৮ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। শিল্প খাতে বিতরণ করা ঋণের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণের অঙ্ক ৮৯ হাজার ২৩২ কোটি টাকা, যা তিন মাস আগে ছিল ৯০ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, শিল্প খাতে ছোট প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বড়দের খেলাপির হার বেশি। কারণ বড় প্রতিষ্ঠানগুলো খেলাপি হওয়ার পরও বারবার ঋণ পাচ্ছে। তাই এ খাতে খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে। এছাড়া পুনঃতফসিলকরণ ও পুনঃগঠন সুবিধার কারণে এ খাতের দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ খেলাপি ঋণের চেয়ে অনেক বেশি।

তিনি বলেন, বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কাছে খেলাপি ঋণ বেশি। এরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। যারা ধরাছোঁয়ার বাইরে তাদের নতুন করে ঋণ দেয়া বন্ধ করে দিতে হবে। নতুন ঋণ যাতে না বাড়ে এটা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই এ খাতে খেলাপি ঋণ কমবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী খেলাপি হলে নতুন করে ঋণ পাওয়ার কথা নয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক সাম্প্রতি পুনঃতফসিলি সিদ্ধান্ত ব্যাংকের কাছে ছেড়ে দিয়ে একটা উদার নীতি দেখিয়েছে। এতে খেলাপি কমার চেয়ে আরও বাড়বে। এছাড়া আইনি প্রক্রিয়া দুর্বল হওয়ার কারণে খেলাপি ঋণ আদায় হচ্ছে না। এর ফলে ব্যাংকগুলো আইনি প্রক্রিয়া আদায় করতে আগ্রহ দেখায় না। তাই এ প্রক্রিয়া আরও সহজ করতে হবে। আর আইনি প্রক্রিয়া সহজ হলেই খেলাপি ঋণ আদায় বাড়বে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০