রোহান রাজিব: চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ৩ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। এটি পূর্ববর্তী প্রান্তিকের চেয়ে ১৪ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা কম। প্রথম প্রান্তিকে পুনঃতফসিল কম হওয়ায় বেড়েছে খেলাপি ঋণ। গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা বেড়ে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, গত বছরের শেষ তিন মাসে খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাংকগুলো বেশি পুনঃতফসিলে ঝুঁকেছে। কারণ বছরের শেষ প্রান্তিকে ব্যাংকগুলো ব্যালান্স শিট ভালো দেখাতে খেলাপি ঋণ আদায় ও পুনঃতফসিলে জোর দেয়। তাই ওই প্রান্তিকে ১৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ কমেছে। আর চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের চাপে রাখে; যাতে তারা কিস্তি পরিশোধ করে । তাই ব্যাংক পুনঃতফসিলের চেয়ে টাকা আদায়ে বেশি জোর দেয়। তাই এ প্রান্তিকে পুনঃতফসিল কম হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিতে মূলত নতুন নীতিমালার আলোকে ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ব্যাংকগুলো। জানুয়ারি-মার্চ সময়ে পুনঃতফসিল হয়েছে ৩ হাজার ৩৭৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর বিপরীতে মাত্র ৫৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা সুদ মওকুফ করেছে ব্যাংকগুলো। এর আগের প্রান্তিকে ১৭ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা পুনঃতফসিল করা হয়, যার বিপরীতে সুদ মওকুফের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে ঋণ পুনঃতফসিল কমেছে ১৪ হাজার ৩৯১ কোটি ১৮ লাখ টাকা। একই সময়ে একই সময়ে সুদ মওকুফ কমেছে ১ হাজার ৮৩৯ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।
তবে বছরের তুলনায় খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল পরিমাণ বেড়েছে। এক বছরের তুলনায় খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল বেড়েছে ১ হাজার ১২২ কোটি টাকা। গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছিল ২ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এমরানুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, বছরের শেষ প্রান্তিকে ব্যাংকগুলো ব্যালান্স শিট ভালো দেখানোর জন্য খেলাপি ঋণ আদায়ে অনেক জোর দেয়। ওই সময়ে গ্রাহকরা পুনঃতফসিল করার জন্য আসে। তাই এ সময় ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়ে পুনঃতফসিল করে, যাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে না যায়। আর মার্চ প্রান্তিকে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের চাপে রাখে, যাতে তারা টাকা-পয়সা দেয়। এজন্য ব্যাংক পুনঃতফসিল করতে চায় না। তাই আগের ডিসেম্বর প্রান্তিক তুলনায় মার্চ প্রান্তিকে পুনঃতফসিল কম হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার আলোকে অনেক আগে থেকেই খেলাপি ঋণ পুনঃফসিল করতে পারে ব্যাংকগুলো। তবে শর্ত শিথিল করে গত ১৮ জুলাই নতুন নীতিমালা জারি করা হয়। নতুন নীতিমালায় ডাউন পেমেন্টের হার কমিয়ে বকেয়ার আড়াই থেকে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। আগে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ডাউন পেমেন্ট বা এককালীন জমা দিতে হতো। আবার আগে কোনো ঋণ একবারে সর্বোচ্চ তিন বছরের জন্য পুনঃতপশিল করা যেত। এখন ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ প্রথম দুই দফা ৮ বছর করে ১৬ বছর, তৃতীয় দফায় ৭ বছর এবং চতুর্থ দফায় ৬ বছরের জন্য পুনঃতফসিল করা যাবে। এভাবে পুনঃতফসিলের পর নতুন ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ‘সমঝোতার অঙ্ক’ জমা দেওয়ার শর্তও শিথিল করা হয়েছে।
খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময় ছাড় দিয়েছেন। নানা রকম ছাড় দিয়েও ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমাতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কভিডের প্রকোপের কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে ঋণ পরিশোধে পুরোপুরি ছাড় ছিল। কম সুদে ঋণপ্রাপ্তি ও ঋণ পরিশোধে কিছুটা ছাড় ছিল গত বছরেও। চলতি বছর থেকে ছাড় পুরোপুরি তুলে নেওয়া হয়েছে।
তবে গত মঙ্গল ও বুধবার দুটি প্রজ্ঞাপন জারি করে আবারও ছাড় দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ১ এপ্রিল থেকে বিদ্যমান নিয়মিত মেয়াদি প্রকৃতির ঋণের (স্বল্পমেয়াদি কৃষি ও ক্ষুদ্রঋণসহ) বিপরীতে (এপ্রিল-জুন) সময়ের জন্য যে কিস্তি দিতে হবে, তার ৫০ শতাংশ পরিশোধ করলেই গ্রাহককে খেলাপি করা যাবে না। এই নির্দেশনা অনুযায়ী সুবিধা নেয়া গ্রাহকদের কিস্তির বাকি অংশ বিদ্যমান ঋণের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে আদায় করতে হবে। এই নির্দেশনা অনুযায়ী ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে এসব ঋণ যথানিয়েমে খেলাপি করা যাবে। যেসব গ্রাহক এই সুবিধা নেবেন, তাদের কিস্তি পরিশোধের ক্ষেত্রে সুবিধাপ্রাপ্ত ঋণের ওপর ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত কোনোরূপ দণ্ড সুদ বা অতিরিক্ত ফি (যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন) আরোপ করা যাবে না। আগে পুনঃতফসিলের মাধ্যমে খেলাপিমুক্ত হয়েছেন, এমন গ্রাহকরাও ঋণ পরিশোধের এই সুবিধা পাবেন।একই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তলবি ঋণের কিস্তি পরিশোধেও।