Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 5:13 am

তিন মাস ধরে ঝুলে আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা

শওকত আলী : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দীর্ঘসূত্রতায় আটকে আছে এসএমই ঋণের সার্ভিস চার্জ কমানোর নির্দেশনা। ফলে বাড়তি আট ধরনের সার্ভিস চার্জ নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, এসএমই খাতে ঋণ বিতরণে অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ নিচ্ছে কিছু ব্যাংক। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো ১৪ ধরনের সার্ভিস চার্জ নিচ্ছে, যার মধ্যে আটটি চার্জের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক অবগত ছিল না এবং এ চার্জগুলোর বেশিরভাগই গোপনে (হিডেন চার্জ) নেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, বাড়তি চার্জগুলো বাতিল করতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা প্রদান করা হবে। কিন্তু এরপর তিন মাস পেরিয়ে গেলেও নির্দেশনাটি এখনও জারি করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ব্যাংকগুলো এ ধরনের বাড়তি চার্জের সুবিধা নিয়েই যাচ্ছে।

অভিযোগ উঠেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন একটি পক্ষের নির্দেশে এটি সার্কুলার আকারে জারি হচ্ছে না। আর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ‘অনুরোধেই’ নির্দেশনাটি দিচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত আগস্টে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, বাড়তি আটটি চার্জ বাতিল করে সবগুলো ব্যাংককে ছয়টি চার্জ নেওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হবে। কারণ বিআরপিডি সার্কুলার নং-১৯/২০০৯ অনুযায়ী ‘ঘোষিত বা প্রকাশিত তালিকাবহির্ভূত কোনো চার্জ বা ফি আরোপ করা যাবে না। চার্জ বা ফি’র কোনো পরিবর্তন করা হলে আবশ্যিকভাবে ব্যাংক তার স্ব-স্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি বিভাগকে অবহিত করতে হবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক সময় সময় এসব বিষয়ে আলোচনা করে তা যৌক্তিককরণের ব্যবস্থা করবে।’ এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের মার্চভিত্তিক চার্জের তথ্য নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। তারা বিভিন্ন ব্যাংকের ১৪টি চার্জের তালিকাকে ছয়টিতে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ব্যাংকগুলো যেসব বিষয়ে সার্ভিস চার্জ নিত, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে লোন প্রসেসিং ফি, লোন অ্যাপ্লিকেশন ফি, ডকুমেন্টেশন ফি, সার্ভিস চার্জ, আরলি সেটেলমেন্ট ফি, পারশিয়াল সেটেলমেন্ট ফি, রি-শিডিউল ফি, লিমিট এক্সচেঞ্জ ফি, লিগ্যাল ফি, অ্যাপ্রাইজাল ফি, লেট পেমেন্ট ফি, সিআইবি চার্জ, স্ট্যাম্প চার্জ এবং অন্যান্য চার্জের মধ্যে রয়েছে রিনিউয়্যাল ফি।

এই ১৪টির মধ্য থেকে যে ছয়টি নির্ধারণ করা হয়েছে, সেগুলো হলো: লোন অ্যাপ্লিকেশন ফি, ডকুমেন্টেশন ফি, আরলি সেটেলমেন্ট ফি, সিআইবি চার্জ, স্ট্যাম্প চার্জ, লিগ্যাল অ্যান্ড ভ্যালুয়েশন ফি। এর মধ্যে লোন অ্যাপ্লিকেশন ফি ২০০ টাকা এবং ভ্যাট এর বেশি নেওয়া যাবে না। ডকুমেন্টেশন ফি, সিআইবি চার্জ, স্ট্যাম্প চার্জ এবং লিগ্যাল অ্যান্ড ভ্যালুয়েশন ফি’র প্রকৃত অর্থ নিতে হবে। বাড়তি কোনো টাকা নেওয়া যাবে না। আর আরলি সেটেলমেন্টের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দুই শতাংশ চার্জ নেওয়া যাবে। এসব বিষয়ে বিভাগীয় সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার প্রায় তিন মাস পার হলেও সেটি এখনও নির্দেশনা আকারে সার্কুলার জারি করা হয়নি। ব্যাংকগুলোর চাপে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দেরি হচ্ছে বলে জানা গেছে।

তবে সার্কুলার জারির দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী ব্যাংকার্স মিটিংয়ে বিষয়টি উত্থাপন করা হবে। সে সঙ্গে সবগুলো ব্যাংকের প্রধান নির্বাহির কাছ থেকে মতামত সংগ্রহ করে তারপরই এটা চূড়ান্ত নির্দেশনা আকারে দেওয়া হবে। আর এতে করে ব্যাংকগুলোর মুনাফায় কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, তাও চিন্তা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, ১১টি ব্যাংক সে সময় এ ধরনের বাড়তি সার্ভিস চার্জ আদায় করতো। ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে বেসরকারি খাতের আইএফআইসি ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক, প্রিমিয়ার, পূবালী, সোস্যাল ইসলামী, স্ট্যান্ডার্ড, ট্রাস্ট, ইউনিয়ন এবং বিদেশি মালিকানাধীন ব্যাংক আল-ফালাহ ও কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন।

এর মধ্যে লোন প্রসেসিং ফি’র নামে আইএফআইসি ব্যাংক দশমিক ২৫ থেকে এক শতাংশ বা ১৫০০-২৫০০০ টাকা, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক এক থেকে দেড় শতাংশ, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ৩০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা, ট্রাস্ট ব্যাংক দুই হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা এবং কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন দশমিক তিন শতাংশ থেকে এক শতাংশ পর্যন্ত ফি আরোপ করে থাকে। লোন এপ্লিকেশন ফি ২০০ টাকা এবং এর ওপর ভ্যাট নেওয়ার কথা থাকলেও তারা ৬০০ টাকা পর্যন্ত চার্জ নিয়ে থাকে।

স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া সর্ভিস চার্জের নামে দশমিক তিন থেকে এক শতাংশ পর্যন্ত চার্জ আদায় করে থাকে। পার্শিয়াল সেটেলমেন্ট ফি’র নামে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক এক-দুই শতাংশ এবং কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন এক শতাংশ চার্জ আরোপ করে থাকে। রিশিডিউল ফি হিসেবে আইএফআইসি ব্যাংক লোন প্রসেসিং ফি’র ৫০ শতাংশ, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন দুই হাজার টাকা ফি নিয়ে থাকে। লিমিট এনহেন্সমেন্ট ফি নামে আইসিবি এক হাজার এবং কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন দশমিক তিন থেকে দশমিক পাঁচ শতাংশ হারে চার্জ নেয়। অ্যাপরাইজাল ফি নামে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক এক হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে। লেট পেমেন্ট ফি নামে কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন নেয় দুই শতাংশ। স্ট্যাম্প চার্জের ক্ষেত্রে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে আরও ৫০০ টাকা বেশি নেয় সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক। রিনিউয়াল ফি হিসেবে এক শতাংশ চার্জ নেয় কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন।