Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 10:01 am

তিন মাস পর বাজেটের অন্তর্বর্তী মূল্যায়ন হওয়া উচিত

শেয়ার বিজ ডেস্ক: জাতীয় সংসদে গত বৃহস্পতিবার ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ বাজেট বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ব্যবসায়ীদের সংগঠন মেট্রোপলিটান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই)। গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটি জানায়, ঘোষিত বাজেট বাস্তবায়ন হওয়া জরুরি এবং প্রতি তিন মাস অন্তর বাজেটের একটি অন্তর্বর্তী মূল্যায়ন হওয়া উচিত।

এমসিসিআই জানায়, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও পর্যায়ক্রমিক পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন সাপেক্ষে বাজেটের বাস্তবায়ন হওয়া উচিত। চলমান মহামারি এটিকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। অতএব, এমসিসিআই মনে করে, তিন মাস পরে বাজেটের একটি অন্তর্র্বর্তী মূল্যায়ন হওয়া উচিত। পরবর্তী বছর থেকে প্রতি তিন মাসে অন্তর্র্বর্তী মূল্যায়ন করা উচিত। প্রয়োজনে এটি পুনর্গঠন ও সেই অনুযায়ী সংশোধন করা যেতে পারে। অনেক অজানা সমস্যা মোকাবিলা করার প্রয়োজন হতে পারে এবং সমাজ ও অর্থনীতিতে এর সেই সমস্যার প্রভাব রয়েছে।

দায়িত্বশীল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন হিসেবে এমসসিআিই আশাবাদী যে, প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এবং অর্থমন্ত্রী ও তার দপ্তরের যথাযথ কার্যক্রমের মাধ্যমে খুব দ্রæতই বাংলাদেশ তার আগের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থায় ফেরত আসতে সক্ষম হবে। এমসিসিআই দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে বরাবরের মতোই তার পরামর্শ ও সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে।

এমসিসিআই বিশ্বাস করে, বাংলাদেশ তার ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা ও বাণিজ্য ব্যবস্থা উন্নতির মাধ্যমে রপ্তানির ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী গন্তব্যে পরিণত হতে পারে। এটি একটি কার্যকর রপ্তানি ব্যবস্থার বিকাশ করতে পারে বিশেষ করে ইউক্রেন সংকটের পরে সম্ভাব্য নতুন বিশ্ব ব্যবস্থাকে পুঁজি করে, যাতে সুপ্ত সুযোগগুলো ব্যবহার করা যায় এবং নতুন সম্ভাবনা তৈরি করা যায়। রপ্তানি বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশের পণ্য ও বাজারের ক্ষেত্রে রপ্তানি বহুমুখীকরণের জন্য পর্যাপ্ত ও অর্থপূর্ণ গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার এজেন্ডা হিসেবে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, অবকাঠামো ও দক্ষতা উন্নয়ন এবং প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিশালীকরণসহ রপ্তানি সুবিধার ক্ষেত্রে টেকসই সংস্কার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রেখে স্বল্প খরচের তহবিল তৈরি করা উচিত, যাতে রপ্তানিমুখী শিল্প তার সক্ষমতা ও দক্ষতা উন্নয়ন করতে সক্ষম হয়। এছাড়া রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার থেকে কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করা এবং তাতে সব রপ্তানিকারকের অভিগম্যতা থাকা উচিত। আইডিএ, এডিবি, আইএফসি, ইত্যাদির মতো উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে সরকার প্রয়োজনীয় আলোচনা চালাতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি) ও তার অনুমোদিত পরিবেশক (এডি) দ্বারা বিনিয়োগের পরিষেবা চার্জ এবং মুনাফা কমিয়ে ইডিএফের জন্য তহবিলের ব্যয় কমানো যেতে পারে।

চেম্বার মনে করে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে গরিবমুখী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির ওপর নজর দেয়া উচিত। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে দরিদ্র মানুষকে সহায়তার পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা উচিত। প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর জন্য প্রস্তাবিত বরাদ্দ এক লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। চলতি অর্তবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় যা মাত্র দুই হাজার কোটি টাকা বেশি। তাই এমসিসিআই মনে করছে আসন্ন বাজেটে বরাদ্দ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে হবে।

এমসিসিআই কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকারের অব্যাহত প্রচেষ্টার জন্য প্রশংসা করছে। গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠী, প্রত্যাগত অভিবাসী শ্রমিক এবং গ্রামীণ যুবকদের যারা প্রশিক্ষিত ও বেকার জনগোষ্ঠীর স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার জন্য সরকার একটি তহবিল গঠন করেছে। এ তহবিলটি তাদের আত্মকর্মসংস্থান, ছোট ব্যবসা, কুটির শিল্প, কৃষি বা কৃষি-সম্পর্কিত যেকোনো পণ্য উৎপাদনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে। এছাড়া ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’, ‘ভিশন ২০৪১’ ও ‘ডেল্টাপ্ল্যান ২১০০’ বাস্তবায়নের সুবাদে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে আমাদের দক্ষ জনশক্তির কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দারুণ সুযোগ তৈরি হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতে ইতোমধ্যে ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির জন্য কাজ চলছে, যা আমাদের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হওয়ার লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করবে।

নিরাপদ অভিবাসন ও শোভন কাজ নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রচেষ্টা বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি কর্মী বিদেশে বসবাস করছে এবং কাজ করছে। এ বছর বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশে ১০ লাখ কর্মীকে পাঠানোর চেষ্টা করছে। তবে বিভিন্ন পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়নই হবে কর্মসংস্থান সৃষ্টির চাবিকাঠি। সরকারি-বেসরকারি প্রচেষ্টার ফলে দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে সর্বাধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও            আত্ম-কর্মসংস্থান ঘটবে।

এমসিসিআই মনে করে, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবকাঠামো, বিদ্যুতের দুর্বল বণ্টন ব্যবস্থা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য এখনো প্রধান বাধা হিসেবেই থাকছে। এ ছাড়া দুর্বল রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা (বর্তমান অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিলের মধ্যে ৬৯.০২ শতাংশ সংগৃহীত) এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন (বর্তমান অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল পর্যন্ত ৫৫.১৮ শতাংশ বাস্তবায়িত) অর্থনীতির জন্য উদ্বেগের কারণ। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য উচ্চ আমদানি প্রবণতা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিপর্যয় বিবেচনা করে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারের দামে উচ্চ ভর্তুকি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, অন্যথায় ভর্তুকি ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে আরও বৃদ্ধি পাবে।

এমসিসিআই করপোরেট করহার আড়াই শতাংশ কমানোর পরিকল্পনার প্রশংসা করছে। গত তিন বছরের এই ক্রমাগত হ্রাস এ অঞ্চলের অন্যান্য প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে করপোরেট করের হারকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য ব্যবসায়ীদের ক্রমাগত দাবি পূরণের লক্ষ্যে সঠিক পদক্ষেপ। সব রসিদ ও আয় অবশ্যই ব্যাংক স্থানান্তরের মাধ্যমে লেনদেন করতে হবে। ১২ লাখ টাকার অধিক সব খরচ ও বিনিয়োগের টাকা ব্যাংক স্থানান্তরের মাধ্যমে করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে মোবাইল ব্যাংকিং (এমএফএস) ব্যবহারের অনুমতি দেয়া উচিত। পণ্য সরবরাহের জন্য উৎসে কর কর্তনের (টিডিএস) হার কমানোর জন্য এবং পারকুইজিট সীমা বাড়ানোর জন্য চেম্বার সরকারের প্রশংসা করছে। যা হোক, চেম্বার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এমন নির্মাণ, অবকাঠামো, ইত্যাদি পরিষেবাতে উৎসে কর কর্তনের (টিডিএস) হার কমানোর পরামর্শ দিচ্ছে।

এমসিসিআই রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য আয়কর হারের যৌক্তিককরণেরও প্রশংসা করছে। এবারের বাজেটে রপ্তানিমুখী সবুজ কারখানার জন্য এ আয়কর হার ১০ শতাংশ, অন্য সব রপ্তানিমুখী কারখানার জন্য ১২ শতাংশ। যা হোক সব রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য উৎসে কর (টিডিএস) দশমিক ৫ শতাংশ থেকে এক শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এমসিসিআই পরামর্শ দিচ্ছে, এই টিডিএস বর্তমান পরিস্থিতিতে আগের অবস্থায় রাখা উচিত।

প্রস্তাবিত বাজেটে কোম্পানির মুনাফায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণ তহবিল (ডবিøউপিপিএফ) নিট মুনাফা থেকে পরিশোধের প্রস্তাব করা হয়েছে। এমসিসিআই বিশ্বাস করে, এটি কোম্পানির শেয়ারধারক ও অংশীজনদের জন্য অস্পষ্টতা তৈরি করবে। এই পদক্ষেপ সব শিল্পের জন্য ডবিøউপিপিএফের অর্থপ্রদানে অভিন্ন অনুশীলনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

বিশ্বব্যাপী মূল্যবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশেও মূল্যবৃদ্ধির এই প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। একই সময়ে আমাদের মাথাপিছু আয়ও বেড়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ৮২৪ ডলার হয়েছে। এসব বিষয় করমুক্ত সীমা সমন্বয়ের দিকনির্দেশ করে। এ কারণেই বাজেটে ব্যক্তিগত করমুক্ত আয়ের সীমা পূর্বাবস্থায় দেখে এমসিসিআই কিছুটা হতাশ। আমাদের অবশ্যই করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়াতে হবে ও সমন্বয় করতে হবে, যা আমরা এখনও করতে পারিনি। এমসিসিআই করমুক্ত আয়কর সীমা কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করছে। এমসিসিআই এনবিআর থেকে কর প্রত্যর্পণের জন্য একটি প্রতীকী তহবিল রাখারও পরামর্শ দিচ্ছে।