তিস্তার পানিতে ডুবেছে কৃষকের স্বপ্ন

শেয়ার বিজ ডেস্ক:‘বাদাম নিয়্যা খুব মসিবতে (কষ্টে) আছি। চরের ১০-১২ দোন জমিত আবাদ করা সোগ (সব) বাদাম নষ্ট হয়্যা গেইছে। অ্যালাও পানির দেড়-দুই ফুট নিচোত বাদাম আছে। এই অবস্থায় বাদামচাষিরা সবশেষ (সর্বস্বান্ত)। কিছু বাদাম তুলবার পারছি, কিন্তু শুকাবার (শুকানো) পারছি না। এইবার বাদাম চাষ করতে অনেক পরিশ্রম করা লাগছে। এইবার খরার কারণে ক্ষ্যাতোত পানিও বেশি লাগছে। এত যে টাকাপয়সা খরচ হইছে, এটা তো আর পামো না। তিস্তার পানিত হামার অনেক লোকসান।’

কথাগুলো বলছিলেন কৃষক ফয়জুর রহমান। তিনি রংপুরের পীরগাছা উপজেলার তিস্তা নদীর তীরবর্তী ছাওলা ইউনিয়নের শিবদেব (বোল্ডারের মাথা) গ্রামের বাসিন্দা। ভারতের উত্তর সিকিমে ভারী বর্ষণসহ উজান থেকে নেমে আসা ঢল আর দেশের অভ্যন্তরে কয়েক দিনের বৃষ্টিপাতে অভিন্ন এই নদীতে পানি বাড়তে শুরু করেছে। সেই পানিতে তিস্তা নদী এখন টইটম্বুর। খবর: ঢাকা পোস্ট।

তিস্তার তীব্র স্রোতের দিকে তাকিয়ে ফয়জুর রহমান জানান, ঋণ করে এবার প্রায় ২৫০ শতক জমিতে বাদাম চাষ করেন তিনি। সেই বাদাম তুলে ঋণ পরিশোধ করাসহ বাড়ির কিছু কাজ আর নতুন ফসলের বীজ কেনার চিন্তাভাবনা ছিল তার মনে। কিন্তু হঠাৎ তিস্তায় হু-হু করে পানি বাড়তে থাকায় তলিয়ে গেল তার বাদাম ক্ষেত। এখন রাক্ষুসে তিস্তার পানিতে তার আশা-ভরসার বাদাম ডুবে থাকায় চোখে-মুখে পড়েছে হতাশার ছাপ।

এদিকে তিস্তায় আকস্মিক পানি বৃদ্ধির ফলে পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের শিবদেব, গাবুড়ার চরসহ নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে পড়েছে। ফলে নদীঘেঁষা ছাওলা ও তাম্বুলপুর ইউনিয়নের বেশকিছু চরসহ নিচু এলাকায় কৃষিজমি পানিতে তলিয়ে আছে। এতে শুধু ফয়জুর রহমান নন, তার মতো কয়েকশ কৃষকের বাদাম এখন তিস্তার পানির নিচে। অনেকেই পানির নিচ থেকে বাদাম তুলে নৌকাযোগে নিয়ে আসছেন। এখন নদীতীরবর্তী প্রতিটি বাড়ির উঠানে বাদাম আর বাদাম।

শিবদেব বোল্ডারের মাথা গ্রামের বাসিন্দা শরিফা বেগম। বাড়ির উঠানে বসে নষ্ট বাদাম থেকে কিছু ভালো বাদাম আলাদা করার কাজে ব্যস্ত তিনি। নদী থেকে একটু দূরে উঁচুতে থাকা তার বাড়িতে পানি ঢুকতে পারেনি। কিন্তু আশপাশের বাড়ি নদীর কোলঘেঁষা হওয়ায় রয়েছে ভাঙনঝুঁকিতে। কিছুটা নিরাপদে থাকলেও শরিফা বেগমও মনমরা বাদামের করুণ দশায়। তার প্রায় ১৩২ শতক জমিতে চাষ করা বাদামের অর্ধেকই পানির তোড়ে ভেসে গেছে। যেটুকু বাদাম নদী থেকে তুলে আনা সম্ভব হয়েছে, তার অবস্থাও বেশি ভালো নয়।

বৃহস্পতিবার বিকালে সরেজমিনে উপজেলার গাবুড়া ও শিবদেব চর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নৌকা দিয়ে হাঁটুপানি থেকে বাদাম তুলছেন কৃষকরা। যে বাদাম এখন তোলা হচ্ছে তার আংশিক অপরিপক্ব। তবে পানির নিচে থাকায় পচন ধরার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাদামচাষিরা।

নদীর পাড়ে বসেই বালুমাখা বাদাম থেকে ভালো ও পরিপক্ব বাদাম আলাদা করছিলেন আবেদ আলী। আরও কয়েকজন তাকে এই কাজে সহযোগিতা করছিলেন। কিন্তু তাদের কারও মন ভালো নেই তিস্তার ভাঙন, বাঁকবদল আর স্রোতের কুলকুল শব্দে। পানিতে ভেজা বাদাম শুকানোর চেষ্টার কমতি নেই কারও। কিন্তু সূর্যের মুখ দেখা না যাওয়ায় ভেজা বাদাম রোদে শুকাতেও পারছেন না। তাই বেশিরভাগ বাদামে পচন ধরে বাড়ছে নষ্ট বাদামের স্তূপ।

তিস্তায় অসময়ে পানি বৃদ্ধি এবং তাদের ক্ষয়ক্ষতির জন্য ভারতকে দুষলেন আবেদ আলী। এই কৃষক বলেন, ‘ভারতের অসময়ের পানির জনতে হামার আজই এই ক্ষতি। আর যদি দুইটা দিন দেরি করি পানি ছাড়ি দেইল হয়, তাইলে এই অবস্থা হইল না হয়। খালি হামার অ্যাটে নোয়ায়, চরোত অ্যালাও বহু বাদাম পানির তলোত আছে। সারা গ্রাম ঘুরি দেখো সবার বাদামের অবস্থা খারাপ। হামার বহু বাদাম নষ্ট হয়্যা গেইছে। অ্যালা যেইকন্যা (যতটুকু) বাদাম তুলি আনছি, সেটাও শুকাবার (শুকানো) জায়গা নাই। হামার বাড়িতো জায়গা নাই পানি উঠতে, মাটি স্যাঁতসেঁত। চরের চাইরোপাকে খালি (শুধু) বাদাম যেমন চাষ হইছে, তেমন বহু বাদাম নষ্ট হইছে।’

মহির শেখ নামে আরেক বাদামচাষি জানান, তিস্তার পানি কখন বাড়বে বোঝার উপায় নেই। শিবদেব বোল্ডারের মাথা থেকে তিস্তার পুরো চরজুড়ে বাদামের চাষ করেছেন শত শত কৃষক। আচমকা পানিতে সবাই এখন ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত। বাদামের এই ক্ষতি পুষিতে উঠতে অনেক সময় লাগবে। কারণ এখানকার বেশিরভাগ মানুষ চাষাবাদনির্ভর আয়ে দিনাতিপাত করেন।

নদীপাড়ের এসব ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় চাষিদের খোঁজ নেননি কৃষি কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট কেউ। প্রতিবছর চর ও নিম্নাঞ্চলে থাকা চাষিরা তিস্তার গ্রাসে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তাদের জন্য কৃষি প্রণোদনার বরাদ্দ ঠিকমতো পৌঁছে না বলে অভিযোগ করেন শিবদেব এলাকার কৃষক ফারুক হোসেন। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ বন্যা হওয়ার কারণে বাদামসহ অনেক আবাদের ক্ষতি হয়েছে। এসব দেখার জন্য কেউ নেই। অনেক সময় অনেক নেতা এসে আশ্বাস দিয়ে যান, কিন্তু কাজ করেন না। এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি কর্মকর্তা এই এলাকায় আসেননি। আমাদের হাজার হাজার একর জমির বাদাম পানিতে ভেসে যাচ্ছে। যেটুকু বাদাম তুলে আনা সম্ভব হয়েছে, সেটাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, পীরগাছা উপজেলায় এ বছর ১৬৫ হেক্টর জমিতে বাদাম আবাদ করা হয়েছিল। এর মধ্যে তাম্বুলপুর ও ছাওলা ইউনিয়নের চরাঞ্চলে বেশিরভাগ আবাদ করা হয়েছিল। কিন্তু উজানের পানির কারণে হঠাৎ বন্যায় সে লক্ষ্যমাত্রা এবার অর্জিত হবে না।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, পীরগাছা উপজেলার কয়েকটি চরাঞ্চলে বাদাম চাষ করা হয়। তবে অনেকে আগে অন্য ফসল চাষ করে, তারপর চাষ করে বাদাম। প্রথমই বাদাম চাষ করা হলে পানিতে তলিয়ে যেত না।

রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, উজানের ঢল আর গত কয়েক দিন ধরে বৃষ্টিপাতের কারণে ডালিয়া ও কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তায় পানি বাড়তে শুরু করেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ডালিয়া ব্যারাজের সব কটি গেট খুলে রাখা হয়েছে। কাউনিয়া পয়েন্টে কিছুটা বাড়ছে পানিপ্রবাহ। এ ছাড়া ভাটি অঞ্চলে সার্বক্ষণিকভাবে নদীপাড়ের পরিস্থিতির খোঁজখবর রাখা হচ্ছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০