তুরায় এক দিন এক রাত

গত ফেব্রুয়ারিতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার উদ্দেশে ভারত যাওয়ার জন্য এক বছরের ভিসা পাই। দুর্ভাগ্যবশত বইমেলায় যাওয়া হয়নি। তাই ভাবছিলাম সুবিধামতো সময়ে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই একবার দার্জিলিং ঘুরে আসব, কিন্তু সে সময়টাও হয়ে উঠছিল না। ইতোমধ্যে ভিসার মেয়াদ প্রায় আট মাস পেরিয়ে গেছে। এ অবস্থায় কাকতালীয়ভাবে বৈশাখী টিভির জেলা প্রতিনিধি বিপ্লব দে কেটুর সঙ্গে গত ২৬ এপ্রিল রাতে সংবাদসংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলার সময় জানতে পারি, তিনি পরদিন সকালে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরা শহরে যাবেন। তার টার্গেট দিনের মধ্যে ফিরে আসা।
এ কথা শুনে মেঘের রাজ্য বলে খ্যাত মেঘালয়ের পাহাড়ি শহর ‘তুরা’ ভ্রমণের ঝটিকা সফরের সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলি। ২৭ এপ্রিল শুক্রবার থাকায় ছুটির আমেজে ছিলাম। পরদিন সকাল ৯টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম নালিতাবাড়ী শহরে। সেখান থেকে কেটু দাকে সঙ্গে নিয়ে নাকুগাঁও ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে সকাল সাড়ে ৯টায়। সেখানে বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন, কাস্টমস ও বিজিবির চেকিংয়ের পর ভারতের ঢালু সীমান্তের বিএসএফ, কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন শেষ করে সীমান্ত থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরের বারাঙ্গাপাড়া বাজারে যাই। এখান থেকে বাংলাদেশের হাইয়েস মাইক্রোবাসের মতো ১৪ সিটের একটি মাইক্রোবাসে জনপ্রতি ৮০ রুপি করে টিকিট কেটে উঠে পড়ি সেই যানে। বেলা ১টায় (ভারতীয় সময়) বাসটি পাহাড়ি খাড়া উত্তর দিকে উঠতে শুরু করে আঁকাবাঁকা ও উঁচুনিচু পথ বেয়ে। ঘণ্টা খানেক পথ পাড়ি দেওয়ার পর চোখকে আর সামলে রাখতে পারছিলাম না। এ যেন শুধু মেঘের রাজ্য নয়, দিগন্তজুড়ে নৈসর্গিক পাহাড়ের দৃশ্য। অপরূপ প্রকৃতি মনকে ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ করে দেয়।
পাহাড় বেয়ে চলা মেঘেদের ছেটানো জল ও হিমেল বাতাস যেন বাসের ভেতর ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছিল। মেঘেরাও যেন পাহাড়ের কোলঘেঁষে আমাদের বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলছিল। জালানার ফাঁক থেকে চোখকে ফেরাতে পারছিলাম না। পাহাড়ের ঢালুতে দূরের কিছু বাড়ি, সেখানকার মানুষের জীবন-জীবিকার নানা দৃশ্য এবং আদিবাসী গারোদের নানা ফসল-ফলের পসরার দোকান চোখে পড়ে বেশ কিছু স্থানে। দেখতে দেখতে দুই ঘণ্টা যেন দুই মিনিটে পার হয়ে গেল। একপর্যায়ে চলে আসি তুরা শহরে। এই শহরের প্রাণকেন্দ্র সুপার মার্কেটের সামনে নেমে পড়লাম আমরা। তখন বেলা ৩টা। ঝটপট মধ্যম মানের একটি হোটেলের রুম নিয়ে দুপুরের খাবারটা সেরে ফেলি। তুরাতে আলাদা কোনো খাওয়ার হোটেল নেই বললেই চলে। এখানকার সব আবাসিক হোটেলে খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। ভাত-মাছ, ভর্তা, সবজিসহ প্রায় সবকিছুই পাওয়া যায়। তবে দাম একটু চড়া। শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দুই-চারটি ঝুপড়ি ও টিনশেড ঘরের মতো খাওয়ার হোটেল রয়েছে। কথায় আছে, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়।’ তাই ভূরিভোজনের চিন্তা কমিয়ে বিকাল ৪টায় বেরিয়ে পড়ি শহরদর্শনে।
শহরের পুরোটাই সড়কের একমাথা থেকে অন্যমাথা পর্যন্ত কমপক্ষে ৪০ থেকে ৫০ ফুট হয় ওপরে নয়তো নিচের দিকে ঢালু। তাই বারবার রাস্তা ভেঙে হাঁটতে হাঁটতে হাঁপিয়ে উঠছিলাম। একপর্যায়ে বেলা সাড়ে ৪টার দিকে সিদ্ধান্ত নিই তুরার অন্যতম আর্কষণ প্রায় পাঁচ কিলো দূরত্বের সুউচ্চ ‘তুরা পিক’ দেখব। এখান থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের গ্রাম, বিভিন্ন নদী ও খালবিল দেখা যায়। প্রায় ঘণ্টা খানেক পাহাড় বেঁয়ে ওঠার পর বিকাল ৫টার দিকে স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছে জানতে পারলাম, পিকের চূড়ান্ত স্থানে যেতে বা উঠতে রাত হয়ে যাবে।
‘তুরা পিক’ স্পটটিতে উঠতে খাড়া সিঁড়ি ও কিছুটা পথ ঢালাই খাড়া রাস্তার পর শেষের পথটা খাড়া মাটির পথ। তুরা শহরে বৃষ্টি কখনও
বলে-কয়ে আসে না। মেঘগুলো অনেকটা চুপিসারে এসে চলে যায়। তবে যাওয়ার সময় গা ভিজিয়ে দিলে বোঝা যায় এখানে বৃষ্টি হয়েছে। তাই রিস্ক না নিয়ে ফিরে এলাম শহরের অন্যতম বেড়ানোর স্থান ‘ডিসি পার্ক’ দেখার জন্য।
১০ রুপি দিয়ে টিকিট কেটে পাহাড়ের ঢালুতে মনোরম দৃশ্যের স্পটটি মনকে সতেজ করে তোলে। ডিসি পার্কের বেঞ্চে বসে কিছুক্ষণ দূরের প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য ও মেঘেদের ছোটাছুটি দেখে মনকে চাঙা করে সেখান থেকে সন্ধ্যার আগেই বেরিয়ে পড়ি শহরের সুপার মার্কেট এলাকায়।
এখানে ফুটপাতের ধারের চটপটি খেয়ে পাশের একটি দোকানে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে উঠে পড়ি তুরার একমাত্র বহুতল ও বৃহৎ সুপার মার্কেটে। সেখানে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে রাত ৭টা পর্যন্ত ঘোরাঘুরি ও কেনাকাটা করে বেরুনোর সময় লক্ষ করলাম রাত হয়েছে। দোকানপাট বন্ধের হিড়িক পড়েছে।
জানতে পারলাম, তুরা শহরে রাত ৮টার মধ্যে সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রাত ৯টার মধ্যেই ভুতুরে শহরে পরিণত হয়। তাই দেরি না করে অনেক খোঁজাখুঁজি করে একটি রুটির দোকান বের করে সেখানে রুটি ও সবজি গিলে সকালের জন্য হালকা নাস্তা ও পানি নিয়ে হোটেলের দিকে এক ছুট। হঠাৎ দেখি তুরা পুলিশ গ্রাউন্ডের পাশের মাঠে চলছে মিনা বাজার। আমাদের দেশে যাকে বাণিজ্যমেলা বলে। চকমকে আলোর ঝলকানি দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। ১০ রুপি দিয়ে টিকিট কেটে ঢুকে পড়ি মেলার মাঠে। মাঠে ঢুকে চোখ ছানাবড়া। নানা বাহারি পণ্য ও খাবারের স্টলের পাশাপাশি বিভিন্ন রকমের জুয়া ও নাগিন ড্যান্স চলছে। তবে সম্পূর্ণ মার্জিতভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এখানে কিছুক্ষণ থাকার পর বন্ধের হুইসেল পড়ার পর মাঠ শূন্য হয়ে পড়তে থাকে। রাতে তখন ঘড়ির কাঁটা ৯টা ছুঁই-ছুঁই।
হোটেলে চলে আসি। আমাদের হোটেলটির লবি থেকে পুরো শহরের ভিউ দেখা যাচ্ছিল। দেখে অনেকটা হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। পাহাড়ের কোলঘেঁষে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে তিন থেকে চার স্তরে বিভিন্ন সড়কে চলাচলরত বিভিন্ন যানবাহনের লাইটের ছোটাছুটি দেখে মনে হয়েছিল রাতটা এখানে বসেই কাটিয়ে দিই। মন চাইলেও শরীরের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়ায় রাত ১২টার দিকে চোখ আর খোলা রাখতে পারলাম না।
সকালবেলায় চলে আসতে হবে বলে ভোরের দিকে ঘুম থেকে উঠি। সকাল ৬টার দিকে ভাবলাম একটু মর্নিং ওয়াক করে নিই, ভোরের তুরা শহরটা দেখে নিই। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর বেলা ৭টার দিকে লক্ষ করলাম, এখানে তো অনেক বেলা, কিন্তু সরাসরি সূর্য দেখা যাচ্ছে না।
তখন তুরা শহরের পূর্ব দিকে শহরের গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সুউচ্চ ‘তুরা পিক’ পাহাড়ের দিকে নজর গেল। পহাড়ের গা সূর্যকে ঢেকে রেখেছে। সকাল ৮টার আগে সরাসরি সূর্যের মুখ দেখা সম্ভব নয় তুরা শহর থেকে। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে হোটেলে ফিরে যাই।
সকাল ৯টার দিকে একটি অটোরিকশা নিয়ে চলে যাই ‘তুরা-ঢালু’ বাসস্ট্যান্ডে। সেখানে বাসের দেখা না পেয়ে বিকল্প রাস্তা হিসেবে মেইন রোড়ে এসে মাইক্রোবাসের জন্য অপেক্ষা করি, কিছুক্ষণ পর পেয়ে যাই।
সাড়ে ৯টায় মাইক্রোবাসে চড়ে ঢালু সীমান্তে পৌঁছাই বেলা সাড়ে ১১টার দিকে। তুরা থেকে ফেরার সময় ঢালু রাস্তার কারণে অল্প সময়ের মধ্যে ঢালু বারাঙ্গাপাড়া বাজারে চলে আসি। এরপর ভারত ও বাংলাদেশের বিজিবি-বিএসএফ, ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস পেরিয়ে বাংলার মাটি ছুঁই বেলা দেড়টার দিকে।
তুরা শহরে ঘুমের সময়টা বাদ দিলে মাত্র ছয় ঘণ্টায় ঘুরে এলে কিছুই দেখা সম্ভব নয়। শহরটি খুব বেশি বড় না হলেও পাহাড়ি উঁচুনিচু ঢালের কারণে বেশ দূরে অনেক সরকারি-বেসরকারি অফিস, স্কুল-কলেজ ও খ্রিষ্টানদের চার্চ থাকায় একেবারে ছোট শহরও বলা যাবে না। বেশ পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট। যানজট নেই। উঁচুনিচু ঢালু রাস্তার কারণে রিকশা চলে না এখানে। পেট্রলচালিত অটোরিকশাই (বাংলাদেশের সিএনজিচালিত অটোরিকশার মতো) ভরসা শহরবাসীর।
তুরা থেকে চলে আসার পর খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, সেখানে নেহেরু ও গান্ধী পার্ক, বোটানিক্যাল পার্ক, রিসোর্ট, মনোরম খ্রিষ্টান চার্চসহ আরও বেশ কিছু বেড়ানোর স্থান রয়েছে। কমপক্ষে দুই থেকে তিন দিনের জন্য তুরায় অবস্থান নিয়ে ঘোরাঘুরি করলে প্রায় সবকিছু দেখা সম্ভব।
গারো খ্রিষ্টান অধ্যুষিত তুরা শহরকে গির্জার শহরও বলা যেতে পারে। এখানে কিছুদূর পরপর ছোট-বড় গির্জা চোখে পড়ে। বাঙালি কিংবা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক থাকলেও আকর্ষণীয় কোনো মন্দির চোখে পড়েনি। মুসলমানের সংখ্যা খুবই নগণ্য হলেও শহরে একটি দোতলা মসজিদ রয়েছে।
সমুদ্র সমতল থেকে তুরার গড় উচ্চতা ৩৪৯ মিটার। অফিশিয়াল ভাষা ইংরেজি। তবে
ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার জন্য গারোদের পাশাপাশি বাঙালিরা গারো ভাষায় কথা বলে। এছাড়া এখানকার প্রায় সব শ্রেণির মানুষ ইংরেজি পত্রিকা পড়ে। এর মধ্যে ‘দ্য শিলং টাইমস’ অন্যতম। ‘দ্য তুরা টাইমস’ নামেও স্থানীয় একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা রয়েছে। গারো অধ্যুষিত তুরার প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় অনেক নারী-পুরুষ তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরলেও শহরের মানুষ বিশেষ করে তরুণ ছেলেমেয়ে বা শিক্ষার্থীরা পাশ্চাত্যের আদলে পোশাক-আশাক পরে।
এখানে উন্নত মানের হোটেলের মধ্যে
হোটেল নটরাজ, রিকম্যান ও সুন্দরী অন্যতম। এছাড়া প্যারাডাউন ও রাজকুমারীও মোটামুটি ভালো মানের।
যারা ট্রেন কিংবা আকাশপথের ভ্রমণে আগ্রহী নন তারা শেরপুরের ইমিগ্রেশন চেক পয়েন্ট দিয়ে তুরা হয়ে মেঘালয়ের শিলং ও আসামের গৌহাটি যেতে পারেন সহজে। নালিতাবাড়ী উপজেলা শহর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে নাঁকুগাঁও স্থলবন্দরসংলগ্ন ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট। এর পরে ভারতের কিল্লাপাড়া বিএসএফ ক্যাম্প থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার অদূরে বারাঙ্গাপাড়া ঢালু বাজার। সেখান থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার উত্তরে তুরায় এক থেকে দুই ঘণ্টা পরপর ছোট বাস চলাচল করে। এছাড়া ১৪ সিটের মাইক্রো বাস আছে। বাস ভাড়া ৬০ টাকা, মাইক্রো ভাড়া ৮০ টাকা।
বৃষ্টির কারণে রাস্তা কিছুটা খারাপ থাকলে এক ঘণ্টার রাস্তায় দেড় ঘণ্টা লাগে। তুরা বাসস্ট্যান্ডে নেমে অটোরিকশায় ২০ টাকায় শহরের সুপার মার্কেট ও বাজার এলাকায় যেতে হবে। সেখানে পছন্দের হোটেলে উঠতে পারেন। আর মাইক্রোবাস চালককে বললে সুপার মার্কেট এলাকার যে কোনো হেটেলের সামনে নামিয়ে দেবে। হোটেলগুলোর মধ্যে ডবল রুম সর্বনি¤œ ৬৫০ রুপি থেকে শুরু করে দুই হাজার রুপি পর্যন্ত রয়েছে। সব হোটেলে নিজস্ব ক্যান্টিন রয়েছে। অর্ডারমতো খাবার পাওয়া যায়। তবে সব খাবারের দাম তুলনামূলক চড়া। খাবারের মানও খুব একটা ভালো নয়। তবে ভ্রমণের কথা চিন্তা করলে খাবারের হিসাব না করাই ভালো।
চাইলে তুরা হয়ে মেঘালয়ের শিলং, চেরাপুঞ্জি ও আসামের গৌহাটি এবং পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি, দার্জিলিং হয়ে নেপাল-ভুটান-সিকিম বেড়িয়ে আসতে পারেন। মাঝখান থেকে পাহাড়ি রাজ্য ও মেঘের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে মেঘের ওপর দিয়ে ছুটে চলা
শাঁ-শাঁ করে রাত কিংবা দিনের বাসযাত্রা হয়ে উঠতে পারে অন্য ধরনের এক ভ্রমণ অভিজ্ঞতা।

রফিক মজিদ

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০