Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 11:41 pm

তৃতীয় লিঙ্গের ইউপি চেয়ারম্যান

দেশব্যাপী চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ৬নং ত্রিলোচনপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীসহ অন্য প্রার্থীদের পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের নজরুল ইসলাম ঋতু। ঋতু ৯ হাজার ৫৫৭ ভোট পেয়েছেন, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকা প্রতীকের নজরুল ইসলাম সানা পেয়েছেন ৪ হাজার ৫২৯টি ভোট অর্থাৎ বিশাল ব্যবধানে জয় হয়েছেন ঋতু। দেশের স্থানীয় নির্বাচনের ইতিহাসে নজরুল ইসলাম ঋতুই প্রথম ব্যক্তি, যিনি নির্বাচনে প্রার্থী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।

ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের বাসিন্দারা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে গিয়ে রাজনীতিবিদদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন। এটি নিয়মিত রাজনীতিবিদদের প্রতি ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও বলা যায়। সরকার দেশব্যাপী উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন করলেও স্থানীয়ভাবে ভোগের রাজনীতির ফলে নাগরিকরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের প্রতি যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, সুযোগ পেয়ে সে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে তৃতীয় লিঙ্গের নজরুল ইসলাম ঋতুকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করার মাধ্যমে। বড় বড় দলগুলোর রাজনীতিবিদরা এটিকে যদি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে বলতেও চায়, তা গ্রহণযোগ্য নয়। এটি অবশ্যই দেশের নাগরিক হিসেবে নজরুল ইসলাম ঋতুর স্বাভাবিক অর্জন। ঋতুর এলাকার জনসাধারণ অন্যান্য প্রার্থীদের চেয়েও ঋতুকে অধিক যোগ্য মনে করাতেই বিপুল ভোটে তাকে জয়ী করেছে।

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের একসময় সমাজে অভিশাপ মনে করা হতো। গ্রামে এমন কথাও প্রচলিত ছিল যে, যাদের ঘরে শারীরিকভাবে অক্ষম পুত্র কিংবা কন্যা অর্থাৎ যাদের আমরা তৃতীয় লিঙ্গ বলি, তাদের জš§ অশুভ এবং পিতা-মাতার পাপের ফসল মনে করা হতো। সময়ের বিবর্তনে সচেতন নাগরিক সমাজ, রাষ্ট্র এবং ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা এই শ্রেণির মানুষদের স্বাভাবিক অধিকার নিয়ে সচেতন হওয়ায় বর্তমানের প্রেক্ষাপট বেশ ভিন্ন। কিছুদিন আগেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তাদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত এবং সমাজ থেকে বিতাড়িত না করে পরিবারের সঙ্গে রাখার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। সর্বশেষ তৃতীয় লিঙ্গের নজরুল ইসলাম ঋতুর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়া নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত এই শ্রেণির নাগরিকদের সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচার পথ প্রশস্ত হয়েছে।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশীয় রাজনীতিতে একসময় পুরুষের আধিপত্য থাকলেও গত ২৫ বছরের রাজনীতির ইতিহাসে নারীরা রাজনীতিতে আসার পাশাপাশি সফলতা হচ্ছে দারুণভাবে। শুধু দেশের প্রধান দুই দলের মূল ব্যক্তিত্ব নারী, এতেই থেমে থাকেনি নারীদের অংশগ্রহণ বরং মেম্বার, চেয়ারম্যান, সংসদ সদস্য, মন্ত্রিসভার সদস্যসহ রাজনীতিবিষয়ক সর্বক্ষেত্রে নারীদের জয়জয়কার। পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিকরাও নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং জয়লাভের মাধ্যমে স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতিতে নিঃসন্দেহে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। সুবিধাবঞ্চিত এই শ্রেণির মানুষদের হয়ে কথা বলার জন্য তাদেরই একজন স্থানীয় সরকারের অংশ হয়েছে। নজরুল ইসলাম ঋতুর দেখাদেখি ভবিষ্যতে অন্যদেরও নির্বাচনে অংশগ্রহণের স্পৃহা বাড়বে। সমাজের বোঝা হয়ে নয়, অন্য আট দশজনের মতো একজন হয়ে সমাজ উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে যোগ্য নাগরিকের ভূমিকা রাখার পথ প্রশস্ত হয়েছে।

ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের বাসিন্দাদের সবাই কিন্তু ঋতুকে ভোট দেয়নি। অনেক ঋতুর বিজয়কে স্বাভাবিকভাবে মেনেও নেবে না। ঋতুর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের পথে বাধা হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া না। কিন্তু ঋতুকে সব প্রতিকূলতা দূর করে নতুন দায়িত্বে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মানিয়ে নিয়ে ইউনিয়নবাসী জন্য কাজ করতে হবে। তাদের আস্থার প্রতিদান দিতে হবে। দেশব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ১২ হাজার তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের একজন হয়ে তাদের স্বাভাবিক নাগরিক অধিকার বাস্তবায়নের জন্য সাধ্যমতো ভূমিকা রাখতে হবে। সেই সঙ্গে ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের বাসিন্দারা তৃতীয় লিঙ্গের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে নাগরিক সেবা গ্রহণে সংকোচবোধ না করে ঋতুকে তাদের মতোই একজন মানুষ হিসেবে গণ্য করে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। অনগ্রসর জনগোষ্ঠী হিসেবে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ যাতে ভবিষ্যতেও দেশীয় রাজনীতিতে অংশ নিতে পারে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করতে পারে, নাগরিক হিসেবে আমাদের তাদের প্রতি সব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। উল্লেখ্য, ধর্মমতে তৃতীয় লিঙ্গ বলে কিছু নেই। প্রত্যেকেই নারী অথবা পুরুষরূপে জš§গ্রহণ করে। তবে তাদের কটূক্তি ও ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে হিজড়া ডাকা হয় বিধায় হিজড়ার পরিবর্তে তৃতীয় লিঙ্গ বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে তারা নারী অথবা পুরুষই হয়। তবে শারীরিকভাবে অক্ষম। যেসব তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ নিজ পরিবারের সঙ্গেই বসবাস করে, তারা পুরুষ হলে পুরুষের মতো কিংবা নারী হলে নারীদের মতোই জীবনযাপন করে। অন্যদিকে যাদের পরিবার ও সমাজচ্যুত করা হয়, তারাই মূলত পোশাক ও সাজসজ্জায় ভিন্নরূপ ধারণ করতে বাধ্য হয়। 

জুবায়ের আহমেদ

শিক্ষার্থী

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইলেকট্রনিক মিডিয়া (বিজেম), ঢাকা