তেলের দায়ে ডুবছে এসএ গ্রুপ

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: ভোজ্য তেল আমদানি করে চট্টগ্রামের একাধিক কোম্পানি বড় হয়েছে। আবার বড় ধরনের লোকসানেও পড়েছে আমদানিকারকরা। ভোজ্য তেলের একসময়ের বড় প্লেয়ার নূরজাহান গ্রুপ ডুবেছে তেল আমদানি করে। ইলিয়াস ব্রাদার্সের পতনও শুরু হয় ভোজ্য তেল দিয়ে। প্রায় একই পরিণতির দিকে যাচ্ছে চট্টগ্রামের আরেক বড় করপোরেট এসএ গ্রুপ। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক শাহাবুদ্দীন আলমের হাতে গড়া এ গ্রুপের অবস্থা এখন নাজুক।

জানা গেছে, গ্রুপটির ভোজ্য তেল ব্যবসা এখন প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রয়োজনে একাধিক ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণ যথাসময়ে পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় দেনা বাড়ছে গ্রুপটির। পাওনা আদায়ে বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে তোলার উদ্যোগও নিয়েছে কোনো কোনো ব্যাংক। এ অবস্থায় সংকট কাটিয়ে উঠতে আবারও ব্যাংকগুলোর সহযোগিতা চান ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ শাহাবুদ্দীন আলম।

ব্যাংকঋণে জর্জরিত এসএ গ্রুপ ভোজ্য তেল ব্যবসায়ও ক্রমে পিছিয়ে পড়ছে। গ্রুপটি গত ২০০৭-০৮ অর্থবছরে মোট ভোজ্য তেল আমদানির ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ আমদানি করে তৃতীয় অবস্থানে ছিল। প্রায় ১০ বছরের ব্যবধানে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে গ্রুপটির তেল আমদানির পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র এক দশমিক ৬৭ শতাংশ।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তথ্যমতে, গত ২০০৭-০৮ অর্থবছরের ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ তেল আমদানি করে এসএ গ্রুপ। আলোচ্য বছরে দেশের ৩৯টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মোট ভোজ্য তেল আমদানি করেছিল সাত লাখ ৫৬ হাজার ৭৪৩ মেট্রিক টন, যার আর্থিক মূল্য ছিল চার হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। সেই বছর তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে থাকা চট্টগ্রামে শিল্পগ্রুপ এসএ গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠান ৬৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ভোজ্য তেল আমদানি করে এক লাখ দুই হাজার ৯৩৯ মেট্রিক টন। অন্যদিকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশের ৮৬টি প্রতিষ্ঠান মোট ভোজ্য তেল আমদানি করে ৩৯ লাখ পাঁচ হাজার ৯৬২ টন। এর আর্থিক মূল্য ছিল ২৩ হাজার ১০৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এর ৩৭০ কোটি ৪২ লাখ টাকা ব্যয়ে ৬৫ হাজার ৩৮৫ মেট্রিক টন ভোজ্য তেল আমদানি করে গ্রæপটি।

যদিও এক দশকে এ খাতে শীর্ষ স্থানে পরিবর্তন আসেনি। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে  ভোজ্য তেল আমদানিতে শীর্ষে ছিল মেঘনা গ্রæপ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরেও তারা শীর্ষেই রয়েছে। আর এক দশক আগে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল সিটি গ্রæপ। বর্তমানে তারা তৃতীয় স্থানে রয়েছে। আর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে চট্টগ্রামের টিকে গ্রুপ।

এদিকে বিভিন্ন ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, গ্রুপটি বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ব্যাংকবহিভর্‚ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন সময়ে বিপুল পরিমাণে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করে। এর মধ্যে ২০১৩ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বৈশ্বিক মন্দা বিবেচনায় বড় ঋণ পুনর্গঠনে দেওয়া বিশেষ সুবিধা নেয় এসএ গ্রুপ। এ গ্রুপের মালিকানাধীন দুই প্রতিষ্ঠান এসএ অয়েল রিফাইনারি ও শামান্নাজ সুপার অয়েল লিমিটেড। মাত্র এক শতাংশ ডাউন পেমেন্টে প্রতিষ্ঠানগুলোর ৯২৮ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল করে ছয়টি ব্যাংক। পুনঃতফসিলকৃত ঋণের কিস্তি দেওয়ার সময় পার হলেও কোনো টাকা পরিশোধ করা হয়নি। এর মধ্যে ব্যাংক এশিয়া ২৫৫ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল করে। কিস্তি পরিশোধের কথা থাকলেও তা করেনি এসএ গ্রুপ।

একইভাবে আবার খেলাপি হয়ে পড়েছে রূপালী ব্যাংকের গ্রাহক শামান্নাজ সুপার অয়েলের ঋণ। এ ঋণ আবার নিয়মিত করতে দৌড়ঝাঁপ করছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার শাহাবুদ্দীন আলম। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক প্রায় ৫৭৪ কোটি ঋণের পাওনা আদায়ে এ গ্রুপের তিন প্রতিষ্ঠানের সব মেশিনারিজ, জাহাজ ও দুই দশমিক ৪৪ একর জমি নিলামে তুলেছে, যা আগামী ২৬ অক্টোবর প্রকাশ্যে বিক্রির জন্য তারিখ নির্ধারণ করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। এর মধ্যে বন্ধকি সম্পত্তির নিলামের মাধ্যমে বিক্রির নোটিশ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা। এছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংকের অনাদায়ী পাওনা আছে ৩৭০ কোটি টাকার অধিক এবং প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেডেরও ৩৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা। আর এসব পাওনা আদায়ে ব্যাংকাররা নিয়মিত গ্রুপ চেয়্যারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে যাচ্ছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসএ গ্রুপের চেয়ারম্যান ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক শাহাবুদ্দীন আলম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘একসময় আমাদের অবস্থান ভালো ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে বাজারধসের কারণে আমরা পিছিয়ে পড়ি। ফলে অনেক লোকসানের সম্মুখীন হই। আর এজন্য আমাদের বিভিন্ন ব্যাংকে পাওনা বেড়ে যায়। এছাড়া পুনর্গঠন করা ঋণ পরিশোধের প্রথম শর্ত ছিল ব্যবসা পরিচালনার স্বার্থে ব্যাংকগুলো আবার অর্থায়ন করবে। তবে বেশিরভাগ ব্যাংক তা না করায় ব্যবসা পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে ঋণ পরিশোধে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। আর ঘুরে দাঁড়াতে ব্যাংকগুলোর সহযোগিতা খুবই প্রয়োজন।’

ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই শীর্ষ কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘চলতি মাসের ৪ তারিখ পর্যন্ত শ্যারিজা অয়েল রিফাইনারি লিমিটেডের কাছে সুদ ও আসল মিলে ৪১৭ কোটি ৮৪ লাখ ৭৬ হাজার ৯৯৪ টাকা, কামাল ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেডের কাছে ১৫৩ কোটি ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৪২৭ টাকা এবং শ্যারিজা নেভিগেশন লিমিটেডের কাছে দুই কোটি ৭৩ লাখ ৪৪ হাজার ৫৯০ টাকা। অর্থাৎ এ গ্রুপের তিন প্রতিষ্ঠানের কাছে অনাদায়ে ঋণের পরিমাণ হয়েছে ৫৭৩ কোটি ৭৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। এ পাওনা পরিশোধে বেশ কয়েক বার তাগাদা দেওয়া হয় এ ব্যবসায়ীকে। কিন্তু পরিশোধে প্রতিবারই ব্যর্থ হন ব্যবসায়ী সাহাবুদ্দীন আলম।’

ব্যাংক এশিয়ার একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বারবার টাকা দেবে বলে। কিন্তু দিচ্ছে না। মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

ইসলামী ব্যাংকের ঋণ প্রসঙ্গে শাহাবুদ্দীন আলম বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংক তো অর্থ পরিশোধে তিনবার তিন রকমের নোটিশ প্রদান করলেও এবার বিশেষ মহলের চাপে পড়ে আমাদের বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রির নোটিশ জারি করেছে। আর ব্যাংক এশিয়া যে কাজ করেছে, তা লজ্জাজনক।’

উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালে থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্য, পানি, পেপার, টেলিকম, তেল রিফাইনারি এবং আবাসন ব্যবসাসহ মোট ১৭টি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে এসএ গ্রুপ।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০