তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা

কাজী সালমা সুলতানা:

২৮ অগ্রহায়ণ ১৩৭৮

বুধবার ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১।

১৫ ডিসেম্বর দিনটি শুরু হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে সরকারবিহীন পরিস্থিতিতে এবং বাতাসে পাওয়া যাচ্ছিল আত্মসমর্পণের আভাস। অবরুদ্ধ ঢাকা তখন থমথমে শহর। রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবীদের ছড়ানো-ছিটানো লাশ, সেলিনা পারভীনের দুই চোখ তখনও বাঁধা, বুকে বুলেট ও বেয়নেটের রক্তের দাগ।

এদিন জেনারেল নিয়াজির যুদ্ধ-বিরতির প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ভোর ৫টা থেকে ঢাকার ওপর বিমান হামলা বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়। পাশাপাশি ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর তরফ থেকে জেনারেল নিয়াজিকে জানিয়ে দেওয়া হয়, পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত কোনো যুদ্ধ-বিরতি হতে পারে না। ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার মধ্যে শর্তহীন আত্মসমর্পণ না করা হলে আবার বিমান হামলা শুরু করা হবে।

এদিন বিকালে যৌথবাহিনী বিনা প্রতিরোধে সাভার প্রবেশ করে। সাভারের পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে এসে রাজধানীর প্রবেশপথ মিরপুর ব্রিজের ওপর প্রতিবন্ধক গড়ে তোলে।

এ রাতে যৌথবাহিনী সাভার থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। পথে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনী ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। রাত ২টায় মিরপুর ব্রিজের কাছে যৌথবাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যের মুখোমুখি হয়। যৌথবাহিনী ব্রিজ দখলের জন্য প্রথমে কমান্ডো পদ্ধতিতে আক্রমণ শুরু করে। ব্রিজের ওপাশ থেকে পাকিস্তানি বাহিনী মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এ সময় যৌথবাহিনীর আরেকটি দল এসে পশ্চিম পাড় দিয়ে আক্রমণ চালায়। সারারাত তুমুল যুদ্ধ চলে।

এদিকে চট্টগ্রাম রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনী কুমিরার দক্ষিণে আরও কয়েকটি স্থান হানাদার মুক্ত করে। সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রাম শহরের প্রথম রক্ষাব্যূহ ভাটিয়ারীতে আক্রমণ চালায়। সারারাত মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ চলে। ভাটিয়ারী থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে।

এদিন যৌথবাহিনী বিভিন্ন দিক থেকে রংপুরের দিকে অগ্রসর হয়। রাতে তারা চারদিক থেকে রংপুর শহর ঘিরে ফেলে। যৌথবাহিনীর পরের দিন রংপুর সেনানিবাসে আক্রমণ করার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ-বিরতির ঘোষণা হওয়ায় তার আর প্রয়োজন হয়নি। এদিন বগুড়া জেলা ও পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি শত্রুমুক্ত হয়।

এদিন ফরিদপুর অঞ্চলে যৌথবাহিনী কামারখালীর পাকিস্তানি ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে অবস্থান ছেড়ে ফরিদপুরের দিকে পালাতে থাকে। যৌথবাহিনী তাদের পিছু ধাওয়া করে। পথে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়ে স্বেচ্ছায় শত্রুসৈন্য যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণকারী অফিসারদের মধ্যে একজন মেজর জেনারেল ছিল।

এদিন বিকাল সাড়ে ৪টায় শহীদ ডা. আবদুল আলীম চৌধুরীকে রাজাকার-আলবদর বাহিনী তার বাসা থেকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায় এবং সারারাত নির্যাতনের পর ভোররাতে নির্মমভাবে হত্যা করে।

এদিন বেলা ১১টায় গভর্নর ডা. মালিক তার মন্ত্রিপরিষদ ও সামরিক-বেসামরিক উপদেষ্টাদের নিয়ে বৈঠক করার মুহূর্তে ভারতীয় বোমারু বিমান গভর্নর হাউসের ওপর রকেট হামলা করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল মানেকশ পাকিস্তানি কমান্ডোরদের আত্মসমর্পণের জন্য শেষবারের মতো নির্দেশ দেন। জেনারেল মানেকশ তার নির্দেশে বলেন, ‘আমি আবার বলছি, আর প্রতিরোধ করা নিরর্থক।’

 এদিন দুপুরের দিকে বগুড়ার পাকিস্তানি ডিভিশন হেড কোয়ার্টার ও ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের পতন হয়। আত্মসমর্পণ করে পরাজিত বাহিনীর এক হাজার ৭০০ সৈন্য ও অফিসার।

এদিন মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে মোকাবিলা করার জন্য বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত ভারতীয় নৌবাহিনীর সমর্থনে সোভিয়েত রণতরীর ২০টি জাহাজ ভারত মহাসাগরে অবস্থান গ্রহণ করে। এরপর মার্কিন রণতরী সপ্তম নৌবহর যুদ্ধে অংশ নেওয়া থেকে নিজেদের গুটিয়ে ফেলে। পাকিস্তানের মনে যুদ্ধে সাহায্য পাওয়ার যেটুকু আশা ছিল, সেটাও এর সঙ্গে শেষ হয়ে যায়। এদিন দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় লেখা হয়‘ইয়াহিয়ার সৈন্যবাহিনীকে তাড়িয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীরা মুক্ত বাংলাদেশে আসতে শুরু করে।’ এদিকে জামায়াতে ইসলামী, পিডিপি, নেজামী ইসলামীর নেতাকর্মীরা অনেকেই মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে আবার অনেকেই আত্মগোপন করে।

তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০