কাজী সালমা সুলতানা:
১০ পৌষ ১৩৭৮, সোমবার
২৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১
বোম্বের সাপ্তাহিক ‘ব্লিৎস’ পত্রিকার সম্পাদক আর কে কারানজিয়া পাকিস্তানি ফ্যাসিস্ট বাহিনীকে বাংলাদেশে নরহত্যা ও ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত করে বিচারের জন্য একটি যুদ্ধ অপরাধ কমিশন গঠনের আহ্বান জানান। ঢাকার বার্তা প্রতিষ্ঠান বিপিআই পরিবেশিত খবরে বলা হয়, ‘ব্লিৎস’ পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যায় ‘শয়তানের বীভৎস মুখ দর্শন’ নামে লিখিত একটি নিবন্ধে কারানজিয়া বলেন, এ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনী সম্পর্কে যে তথ্য লাভ করেছেন, তাতে এটাই প্রমাণিত হয় যে, পাকিস্তানি সৈন্যরা যুদ্ধাপরাধী, যুদ্ধবন্দি নয়। নিয়াজি, ফরমান আলী গং জেনেভা কনভেনশন অনুসারে যুদ্ধবন্দির মর্যাদা পেতে পারেন না। তারা খুনি, তারা নারীর মর্যাদা হরণকারী, তারা সৈনিকের মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করেছেন।
কারানজিয়া অভিমত প্রকাশ করেন যে, ইয়াহিয়াচক্র বাংলাদেশে জাতিসংঘ কিংবা চীন ও মার্কিন হস্তক্ষেপের পথ প্রশস্ত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় নিজেদের একটি পিস্টন ইঞ্জিনবিশিষ্ট বিমান ও দুটি হেলিকপ্টারের সাহায্যে এতিমখানা এবং কতিপয় এলাকায় বোমাবর্ষণ করে। এ হামলায় বহু শিশু প্রাণ হারায়। তিনি আরও বলেন, কমলাপুরে আহত ৩৬ ভারতীয় সৈন্যকে পাকিস্তানি কমান্ডিং অফিসারের নির্দেশে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়।
ভারতীয় সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল শ্যাম মানেকশ সকালে আলাদাভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানীও সে সময় উপস্থিত ছিলেন। বিবিসির এক খবরে বলা হয়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো পিন্ডিতে অন্তরীণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
পুরানা পল্টনে আওয়ামী লীগ অফিসে স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম কর্মিসভায় ভাষণদানকালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের সরকার। তিনি তার মন্ত্রিপরিষদ সদস্য ও নিজেকে জনগণের ‘সেবক’ বলে অভিহিত করেন।
এদিন বিকালে বঙ্গভবনে চারজন নতুন মন্ত্রীর শপথ অনুষ্ঠান শেষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম মন্ত্রিপরিষদ সদস্যসহ পুরানা পল্টনে আওয়ামী লীগ অফিসে যান। আওয়ামী লীগকর্মী ও নেতারা অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ও তার মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের বিপুল সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ সম্পাদক গাজী গোলাম মোস্তফা কর্মীদের উদ্দেশে ভাষণ দেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি প্রসঙ্গে বলেন, এ ব্যাপারে কূটনৈতিক পর্যায়ে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। পাকিস্তান জঙ্গিশাহীর পক্ষে একটি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতিকে বেশিদিন আটকে রাখা সম্ভব হবে না এবং অচিরেই তাকে মুক্ত করা সম্ভব হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
এদিন বাংলাদেশে দখলদার বর্বর পাকবাহিনীর সঙ্গে সহায়তা করার অভিযোগে আরও কয়েকজন দালালকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হচ্ছেন: ড. হাসান জামান, প্রাক্তন পরিচালক, পাকিস্তানবিষয়ক একাডেমি; নাসিরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী (সিলেট), সদস্য, নেজামে ইসলাম, প্রাক্তন প্রাদেশিক মন্ত্রী; তথাকথিত উপনির্বাচনে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য; মওলানা আতাহার আলী, কিশোরগঞ্জ শহর; মওলানা সাঈয়েদুর রহমান, ময়মনসিংহ শহর; বাহাউদ্দিন আহমদ, প্রাক্তন এডিশনাল এসপি, সিলেট; মো. এসবি দোজা, সিও (রেভ), কোতোয়ালি, ঢাকা; নূরুল আমীন, সুপারিনটেনডেন্ট, তেজগাঁও টেলিফোন ওয়ার্কশপ; শাহাবুদ্দিন, ফোরম্যান, ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই; মওলানা বজলুর রহমান, দয়াপুর, কুমিল্লা; এসএম মুজতবা খুরশিদ, প্রাক্তন ওসি, লালবাগ থানা, ঢাকা; এসআই ইউসুফ আলী চৌধুরী, প্রাক্তন ওসি, কালীগঞ্জ থানা, ঢাকা; এসআই মো. ইসহাক, প্রাক্তন ওসি, মোহাম্মদপুর থানা, ঢাকা; হাবিলদার নওয়াব খান, ইপিসিএএফ; শামী, মুজাহিদ কমান্ডার, মিরপুর; মো. আকিল (মুজাহিদ), মিরপুর; মো. আলী ওরফে মো. আখতার আলী (মুজাহিদ), মিরপুর; মান্না ওরফে আবদুল আজিজ (মুজাহিদ), মিরপুর; শুর মোহাম্মদ (মুজাহিদ), মিরপুর; শাহাবুদ্দীন, শত্রুবাহিনীর এজেন্ট; আবদুল জহির (রাজাকার), নোয়াখালী; আনকা ওহি (রাজাকার), পার্বত্য চট্টগ্রাম; আবুল বাশার মো. শাহজাহান (আলবদর), ফেনী, নোয়াখালী; সৈয়দ মো. মোহেন কাদের, মোহাম্মদপুর, ঢাকা; আনিসুর রহমান, কমান্ডার (আলবদর); বিল্লাল হোসেন, কমান্ডার (আলবদর); এসএ সিদ্দিকী, মিরপুর, কমান্ডার (আলবদর); এবিএম খালেক মজুমদার (আলবদর); ওমর হায়াত, মিরপুর; সিরাজউদ্দীন, সদস্য, শান্তিকমিটি; আশরাফ আলী, আলবদর সদস্য, ফরিদাবাদ; এসএম মুনিবুল হক, আহ্বায়ক, শান্তিকমিটি; সৈয়দ এরশাদ হোসেন, তেজগাঁও, ঢাকা; সৈয়দ মো. মহসিন, মোহাম্মদপুর, আলবদর সদস্য; মো. হানিফ, মিরপুর।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর