Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 4:07 pm

তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা

কাজী সালমা সুলতানা:

১৮ অগ্রহায়ণ ১৩৭৮ রোববার, ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১।

এ দিনে নিরাপত্তা পরিষদের পুনরায় যে অধিবেশন বসে, তাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন এক প্রস্তাব উত্থাপন করে। এ প্রস্তাবে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে এমন এক রাজনৈতিক নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন, যার ফলে বর্তমান সংঘর্ষের অবসান নিশ্চিতভাবেই ঘটবে। প্রস্তাবে আরও বলা হয়, পাকিস্তানি বাহিনীর যে সহিংসতার দরুন পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে, তাও অবিলম্বে বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। এ প্রস্তাব একমাত্র পোল্যান্ড সমর্থন করে। চীন বাদে পরিষদের অন্য সব সদস্য ভেটোদানে বিরত থাকে। চীন ভোট দেয় বিপক্ষে। ওইদিন আরও আট দেশের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদে আরও একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। প্রস্তাবের মর্ম মার্কিন প্রস্তাবের অনুরূপ হওয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন তার দ্বিতীয় ভেটো প্রয়োগ করে। এ সময় ‘তাস’ মারফত এক বিবৃতিতে সোভিয়েত সরকার উপমহাদেশের যুদ্ধের জন্য পাকিস্তানকে সর্বাংশে দায়ী করে পূর্ববাংলার জনগণের আইনসংগত অধিকার ও স্বার্থের স্বীকৃতির ভিত্তিতে সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের দাবি জানায়। সোভিয়েত সরকার মনে করে, এ সংঘর্ঘ সোভিয়েত সীমান্তের সন্নিকটে সংঘটিত হওয়ায় এর সঙ্গে সোভিয়েত নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত এবং পরিস্থিতির অবনতি রোধকল্পে বিবদমান পক্ষদ্বয়ের যে কোনোটির সঙ্গে জড়িত হওয়া থেকে বিরত থাকতে বিশ্বের সব দেশের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। উপমহাদেশের সংঘর্ঘে পাকিস্তানের সহায়তায় তার মিত্রদ্বয় কী ব্যবস্থা নিতে পারে, স্পষ্টতই তার সঠিক উপলব্ধির ভিত্তিতে ওই সোভিয়েত বিবৃতি প্রচারিত হয়।

লড়াইয়ের তৃতীয় দিনেই স্বাধীন বাংলার আকাশ শত্রুমুক্ত হয়। বাংলাদেশে পাকবাহিনীর প্রায় সব বিমান এখন বিধ্বস্ত। সারা দিন ধরে ভারতীয় জঙ্গিবিমানগুলো অবাধে আকাশে উড়ে পাক সামরিক ঘাঁটিগুলোয় প্রচণ্ড আক্রমণ চালায় এবং অকেজো করে দেয় বিমানবন্দরগুলো।

ভারতের বিমানবাহিনীর হিসাবমতে, ১২ ঘণ্টায় ২৩১ বারে তেজগাঁও ও কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটিতে ৫০ টনের মতো বোমা ফেলা হয়েছে। পাকবাহিনীর কনভয়ের ওপর ভারতীয় জঙ্গিবিমানগুলো আক্রমণ চালায়। এতে পাকবাহিনীর ৯০টি গাড়ি ধ্বংস হয়। এছাড়াও পাকবাহিনীর সৈন্য বোঝাই কয়েকটি লঞ্চ ও স্টিমারও ধ্বংস হয়।

সাবমেরিন ‘গাজী’ পাক নৌবহরের গর্বের বস্তু। বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ডের সফল আক্রমণে তা ধ্বংস হয়। সাবমেরিনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হতে পাকিস্তান ধার হিসেবে পেয়েছিল।

নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ড চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের সব নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জাহাজকে বন্দর ত্যাগের পরামর্শ দেয়। তারা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতেও অপারগতা প্রকাশ করে। এতে বিশ্বের সব দেশ বুঝতে পারে, বাংলাদেশের বন্দরগুলো রক্ষা করার ক্ষমতা আর পাকবাহিনীর নেই।

মিত্রবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট স্থলপথে এগিয়ে আসতে থাকে। প্রধান সড়ক দিয়ে না এগিয়েও মিত্রবাহিনী বিভিন্ন সেক্টরের প্রধান প্রধান সড়কের কতগুলো এলাকায় অবরোধ সৃষ্টি করে। ফলে ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের; নাটোরের সঙ্গে ঢাকা ও রংপুর এবং যশোরের সঙ্গে নাটোর ও রাজশাহীর যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

ভারতের ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন আখাউড়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আখাউড়ার দক্ষিণ ও পশ্চিমাংশ দিয়ে অবরোধ করে। এখানে পাকবাহিনী মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে অবশেষে আত্মসমর্পণ করে। ফলে আখাউড়া সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়। এ যুদ্ধে সুবেদার আশরাফ আলী খান, সিপাহি আমির হোসেন, লেফট্যানেন্ট বদিউজ্জামান, সিপাহি রুহুল আমিন, সিপাহি সাহাব উদ্দিন, সিপাহি মুস্তাফিজুর রহমান শহীদ হন। আখাউড়া মুক্ত হওয়ার পর কিছু পাকসেনা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পালিয়ে যায় এবং ১৬০ জন মিত্রবাহিনীর হাতে নিহত হয়।

তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও মূলধারা ৭১