কাজী সালমা সুলতানা:
২৪ অগ্রহায়ণ ১৩৭৮, শুক্রবার
১১ ডিসেম্বর, ১৯৭১
এদিন লে. জেনারেল নিয়াজি ঢাকা বিমানবন্দর পরিদর্শন করেন। সেখানে তিনি বিমানবিধ্বংসী কামানের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নেন এবং বলেন, কোনোভাবেই শত্রুকে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া যাবে না। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ঐতিহ্যকে আরও সমুজ্জ্বল করবে। পরে বিমানবন্দরে তিনি বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।
এদিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত বাংলাদেশে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জোর দাবি জানায়। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র রোনাল্ড জিগলার বলেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব মেনে নেওয়া ভারত-পাকিস্তান উভয়ের জন্যই অত্যাবশ্যক। তিনি জানান, প্রেসিডেন্ট নিক্সন এ বিষয়ে নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা কিসিঞ্জারের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন।
যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদর বাহিনীকে পরাজিত করে মুক্তিবাহিনী দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত করে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা অব্যাহত রাখে। দিনাজপুরের হিলি সীমান্তে মিত্রবাহিনী প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে এখানে তুমুল লড়াই অব্যাহত থাকে। সন্ধ্যায় বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের মধ্যবর্তী গোবিন্দগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটিতে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী সম্মিলিতভাবে সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। সারা রাত যুদ্ধের পর পাকিস্তানি বাহিনী ভোরের দিকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
এদিকে জামালপুর গ্যারিসনে সম্মিলিত বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করে। জামালপুরের পূর্বে হালুয়াঘাট এলাকায় প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর পাকিস্তানি বাহিনীর আরেকটি ব্রিগেড প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেলে টাঙ্গাইলের দিকে পালিয়ে যেতে শুরু করে। পলায়নের সময় শত্রুবাহিনী রাস্তার সব বড় সেতু ধ্বংস করে দিয়ে যায়। অন্যদিকে ময়মনসিংহে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর আরেকটি ব্রিগেড শহর ত্যাগ করে টাঙ্গাইলে তাদের প্রতিরক্ষামূলক ঘাঁটিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সম্মিলিত বাহিনী রাতে বিনা প্রতিরোধে জামালপুর দখলে নেয়।
এদিন জাতিসংঘের অনুরোধে বিদেশি নাগরিকদের ঢাকা ত্যাগের ব্যবস্থা করতে সকালে মিত্রবাহিনীর বিমান হামলা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়। মূল উদ্দেশ্য ছিল মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বিমানবন্দর মেরামত করে বিমান ওড়ার সুযোগ করে দেওয়া। সন্ধ্যায় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী যুদ্ধবিরতি ও পাকিস্তানিদের ঢাকা থেকে অপসারণের ব্যবস্থা করার জরুরি আবেদন জানান।
ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, যদিও পূর্বাঞ্চলের যুদ্ধাবস্থা খুব ভালো নয়, তার পরও আমাদের আত্মসমর্পণের প্রশ্নই ওঠে না।
এদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় বিকাল ৩টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করে।
একাত্তরের এদিন হিলি সীমান্তে যৌথবাহিনী প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। মার্কিন সপ্তম নৌবহরের টাস্কফোর্স বঙ্গোপসাগর অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। মিত্রবাহিনী এগিয়ে চলছে। মৌলভীবাজারের পতন আর নরসিংদীতে যৌথবাহিনীর দখল প্রতিষ্ঠা হয়। এদিকে দেশের অধিকাংশ থানায় স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়।
সন্ধ্যায় গোবিন্দগঞ্জে হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটিতে আক্রমণ ও সারা রাত যুদ্ধ শেষে ভোরে গোবিন্দগঞ্জের পতন ঘটে। জাতিসংঘের অনুরোধে বিদেশি নাগরিকদের স্থানান্তরের জন্য ঢাকা বিমানবন্দরে সাময়িক সময়ের জন্য বিমান হামলা স্থগিত হয়। যুদ্ধবিরতির জন্য প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী জাতিসংঘ সদর দপ্তরে জরুরি বার্তা পাঠান। জামালপুর, ময়মনসিংহ, গাইবান্ধা, চণ্ডীপুর, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, ফুলছড়িহাট ও বাহাদুরবাদ ঘাটসহ মুক্ত হয় অবরুদ্ধ বাংলাদেশের ১২টি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর ছয় দিনব্যাপী অবরোধ ও প্রচণ্ড যুদ্ধের পর এদিন ভোরে জামালপুর হানাদারমুক্ত হয়। জামালপুর গ্যারিসনে অবস্থানকারী পাকিস্তানি বাহিনী ২১ বেলুচ রেজিমেন্টের ছয় অফিসার ও ৫২২ সেনা যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। হানাদারদের মধ্যে নিহত হয় ২১২ জন আর আহত হয় ২০০ জন।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর