Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 5:34 am

ত্রুটিপূর্ণ স্টাডিতে চার লেন আখাউড়া-আশুগঞ্জ মহাসড়ক!

ইসমাইল আলী: আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করায় প্রকল্প নেয়া হয় ২০১৭ সালের এপ্রিলে। ট্রান্সশিপমেন্টের পণ্য পরিবহনের সুবিধার্থে ভারতের ঋণে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। তবে চার বছরের মাথায় প্রকল্পটির পরিকল্পনায় ত্রুটি ধরা পড়ে। এতে সংশোধন করতে হয়েছে চার লেনের অ্যালাইনমেন্ট ও ডিজাইন। পাশাপাশি ব্যয় বেড়ে গেছে ৬২ শতাংশ।

যথাযথ ফিজিবিলিটি স্টাডি (সম্ভাব্যতা যাচাই) ছাড়াই প্রকল্পটি গ্রহণ করায়Ñএ ত্রুটি দেখা দেয় বলে মনে করছে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। সম্প্রতি আশুগঞ্জ নদীবন্দর-সরাইল-ধরখার-আখাউড়া স্থলবন্দর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীনতরণ প্রকল্পটির নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন এ বিভাগটি।

প্রতিবেদনে প্রকল্পটির বেশকিছু দুর্বলতা তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি যথাযথভাবে হয়নি বিধায় প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় বিএডিসির (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন) খাল ও সড়কের পাশের পতিত জমির পানি অপসারণ নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এতে প্রকল্পের ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) সংশোধন করতে হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রকল্পের স্কোপ অব ওয়ার্ক পরিবর্তন করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের পিআইসি ও পিএসসি সভা সঠিক সময়ে অনুষ্ঠিত হয়নি। ফলে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়নি।

এদিকে প্রকল্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী যথাযথ কারিগরি জনবল নিয়োগ করা সম্ভব না হওয়ায় প্রকল্পের পরিবীক্ষণ জোরদার হচ্ছে না বলে মনে করছে আইএমইডি। এছাড়া প্রকল্পের তিন প্যাকেজের মধ্যে একটির ঠিকাদার নিয়োগে এখনও চুক্তি সই হয়নি। আর পাঁচ বছরে প্রকল্পটির অগ্রগতি মাত্র ২৫ শতাংশ। ২০২০ সালের জুনে প্রকল্পটি শেষ করার কথা ছিল। তবে বাস্তবায়ন বিলম্বে প্রথম দফা দুই বছর মেয়াদ  বাড়ানো হয়। পরে আরও তিন বছর প্রকল্প মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সব মিলিয়ে পাঁচ বছর বেড়েছে প্রকল্পের মেয়াদকাল। এতে ২০২৫ সালের জুনে প্রকল্পটি শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

তথ্যমতে, বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের মধ্যে সংযুক্তি বৃদ্ধির জন্য আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে সরাইল, ধরখার হয়ে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত ৫০ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণে প্রকল্পটি নেয়া হয়। প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল তিন হাজার ৫৬৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। তবে প্রকল্পটির নকশা সংশোধনের ফলে বিভিন্ন প্যাকেজের নির্মাণব্যয় বেড়ে গেছে। এতে প্রকল্প ব্যয় দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৭৯১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এ হিসেবে চার লেন নির্মাণব্যয় বেড়েছে দুই হাজার ২২৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বা ৬২ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

এদিকে প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটিতে ভারতের ঋণ দেয়ার কথা ছিল দুই হাজার ২৫৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। বাকি এক হাজার ৩১২ কোটি ৯ লাখ টাকা জোগান দেবে বাংলাদেশ। এখন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ভারতের ঋণের পরিমাণ ধরা হয়েছে দুই হাজার ৯৮২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। আর সরকারের তহবিল থেকে দেয়া হবে দুই হাজার ৮০৮ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ ভারতের ঋণ সামান্য পরিমাণ বৃদ্ধি করা হচ্ছে। সরকারি বিনিয়োগই অনেক বেশি বাড়াতে হচ্ছে।

সূত্রমতে, মূল ডিপিপিতে ধীরগতির যানবাহনের লেনের প্রশস্ততা ধরা হয়েছিল তিন দশমিক ৬ মিটার। কিন্তু একনেক (জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটি) সভায় বর্তমান যান চলাচল পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ চাহিদা বিবেচনায় ঢাকা-সিলেট ধীরগতির যানবাহনের লেনের প্রশস্ততা সাড়ে পঁাঁচ মিটার করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এতে আশুগঞ্জ-আখাউড়া মহাসড়কেও প্রথম প্যাকেজের আওতায় আশুগঞ্জ ইন্টারসেকশন হতে সরাইল ইন্টারসেকশন পর্যন্ত ধীরগতির যানবাহনের লেন ঢাকা-সিলেট করিডোরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সাড়ে পাঁচ মিটার প্রশস্ততায় উন্নীত করার নির্দেশনা দেয়া হয়।

এদিকে মূল মহাসড়কের পিসি গার্ডার সেতুর সø্যাবের প্রশস্ততা ১৪ মিটার থেকে ১৬ দশমিক ৪০ মিটারে উন্নীত করতে হয়েছে। আর ধীরগতির যানবাহনের লেনের সেতুর সø্যাবের প্রশস্ততা ছয় মিটার থেকে আট দশমিক ৪০ মিটারে উন্নীত করা হয়েছে।

এর আগে মহাসড়কটির প্যাকেজ ১-এর কাজ নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। মহাসড়কটি চওড়া করতে গিয়ে ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল ভরাট করা নিয়ে বাদ সাধে বিএডিসি। এতে ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সংকটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বলে দাবি করে সংস্থাটি। এ নিয়ে দফায় দফায় বৈঠকের পর বিষয়টি সুরাহা হয়। এক্ষেত্রে ১২টি কালভার্ট পুনর্নির্মাণ করতে হচ্ছে। তবে প্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে এ খাতে বরাদ্দ ছিল না। ফলে ব্যয় বাড়াতে হয়েছে।

এদিকে দ্বিতীয় প্যাকেজের আওতায় নতুন একটি আন্ডারপাস নির্মাণ করতে হচ্ছে। এছাড়া ঋণ চুক্তির শর্ত অনুসারে ভারত থেকে নির্মাণকাজে ব্যবহƒত উপকরণ আমদানি করতে হবে ৬৫ শতাংশ। তবে এক্ষেত্রে ঠিকাদারকে উৎসমুখে যে শুল্ক, আবগারি ও ভ্যাট দিতে হবে তা বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হবে। এ খাতে কোনো ব্যয় ধরা ছিল না। তবে সংশোধিত ডিপিপিতে এ খাতে ৮০৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

প্রকল্পটিতে জমি অধিগ্রহণ খাতেও ব্যয় বেড়েছে। প্রকল্পটির জন্য জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি না পেলেও ২০১৭ সালের আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ প্রদান তিনগুণ করা হয়েছে। তাই এ খাতে ব্যয় বেড়েছে ৮৪৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এছাড়া পরিষেবা সংযোগ লাাইন স্থানান্তরে কোনো বরাদ্দ ছিল না প্রকল্পটিতে। তবে প্রকল্পের আওতায় দুটি রেলওয়ে আন্ডারপাস নির্মাণ করতে গিয়ে এ খাতে নতুন করে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

এর বাইরে ঠিকাদার কর্তৃক ১ম, ২য় ও ৩য় প্যাকেজে যে দর প্রস্তাব করা হয়েছে; তা ডিপিপিতে সংস্থানকৃত অর্থের চেয়ে যথাক্রমে ১৪৪ কোটি ৯৫ লাখ, ৫২৮ কোটি ১৭ লাখ ও ১৮০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা বেশি। আর ডিপিপিতে ভ্যাট ও আয়কর খাতে পাঁচ দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ বরাদ্দ ছিল। তবে তা বেড়ে হয়েছে ১৫ শতাংশ। তাই ওই খাতেও ব্যয় বাড়বে। এছাড়া পরামর্শক খাতেও ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে গেছে।

জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আকবর হোসেন পাটোয়ারী শেয়ার বিজকে বলেন, প্রকল্পটির পূর্ত কাজ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন প্যাকেজের প্রাক্কলিত ব্যয় চুক্তিমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। মূলত এ দুই কারণে প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে গেছে।