Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 3:20 am

ত্রুটিপূর্ণ স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণে বঙ্গবন্ধু সেতুতে ফাটল

সাধারণত ৫০ বা ১০০ বছরের চাহিদার কথা মাথায় রেখে গ্রহণ করা হয় পরিকল্পনা। আর বড় অবকাঠামোগত প্রকল্পের পেছনে থাকে দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়ার আশা। তবে বাংলাদেশে এ চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষেই ধরা পড়ে ত্রুটি। সেগুলো সংশোধনের জন্য আবার নেওয়া হয় প্রকল্প। এতে অপচয় হয় সম্পদ ও সময়ের। এ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ কয়েকটি অবকাঠামো নিয়ে অনুসন্ধান করেছে শেয়ার বিজ। আজ ছাপা হচ্ছে দ্বিতীয় পর্ব

ইসমাইল আলী: যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতু খুলে দেওয়া হয় ১৯৯৮ সালের জুনে, যদিও কয়েক বছরের মাথায় সেতুটিতে ফাটল ধরা পড়ে। মিটারগেজের নকশা করা হলেও পরে সেতুটিতে ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ করা হয়। এতে সেতুতে চাপ বাড়ায় কমিয়ে দেওয়া হয় ট্রেনের গতি। এছাড়া ধরা পড়ে সেতুটির ত্রুটিপূর্ণ নকশার বিষয়টি। এতে দুই দশক না পেরুতেই যমুনা নদীর ওপর পৃথক রেল সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে।

তথ্যমতে, বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল তিন হাজার ৭৪৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। পৃথক রেল সেতু নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১২ হাজার ৯৫০ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু সেতুর প্রায় সাড়ে তিনগুণ ব্যয়ে রেল সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু সেতুতে ফাটলের কারণ অনুসন্ধানে একাধিক গবেষণা করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপকরা। এ বিষয়ে একাধিক জার্নালও প্রকাশ করেছেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের গবেষকরা।

গবেষণাগুলোয় দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু সেতুর নকশা প্রণয়নে ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড (বিএস) ৫৪০০ অনুসরণ করা হয়। সেতু নির্মাণে ১৯৭৮ সালে প্রণীত এ ম্যানুয়াল অনুযায়ী, বাতাসে তাপমাত্রা ২৪-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলে সেতুর উপরিকাঠামোর (সুপারস্ট্রাকচার) তাপমাত্রা ২৭ থেকে ৩৭ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করবে। এরূপ বিবেচনায় নকশা প্রণয়ন করা হয় বঙ্গবন্ধু সেতুর। যদিও সেতুটির প্রকৃত অবস্থা ভিন্ন।

বুয়েটের গবেষণায় দেখা যায়, গ্রীষ্মকালে সেতুটির সুপারস্ট্রাকচারের তাপমাত্রা ১৯ থেকে ৪৫ ডিগ্রি পর্যন্ত ওঠানামা করে। আর শীতে এ তাপমাত্রা ১৩ থেকে ৩২ ডিগ্রির মধ্যে থাকে। আবার গ্রীষ্মে হঠাৎ শিলাবৃষ্টি হলে ঘণ্টার ব্যবধানেই তাপমাত্রা ১০-১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যায়। তাপমাত্রার এ ধরনের পার্থক্য সেতুটির নকশা প্রণয়নের সময় বিবেচনা করা হয়নি। এতে সেতুটির ডেক সø্যাবে ব্যবহার করা রডের সংকোচন ও প্রসারণ ব্যাহত হয়। ফলে নির্মাণ শেষ হওয়ার আগে সেতুতে ফাটল দেখা দেয়, পরে যা বড় হয়েছে। এছাড়া অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে সেতুটির মেরামত কাজও একাধিকবার ব্যাহত হয়।

জানতে চাইলে গবেষণা দলের অন্যতম সদস্য বুয়েটের অধ্যাপক ড. সাইফুল আমীন শেয়ার বিজকে বলেন, ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড হুবহু বাংলাদেশে অনুসরণ করা সম্ভব নয়, কারণ বাতাস, তাপমাত্রা, আর্দ্রতাসহ পরিবেশের অন্যান্য উপাদানের ভিন্নতা রয়েছে এ দেশে। ফলে নকশায় কিছুটা ত্রুটি ছিল। তবে ফাটল মেরামতের সময় এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

তথ্যমতে, ২০১০ সালের আগস্টে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সেতুবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে (আইএবিএসই-জেএসসিই জয়েন্ট কনফারেন্স ইন ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং-টু) বঙ্গবন্ধু সেতুর ফাটলবিষয়ক একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। বুয়েটের পাঁচ অধ্যাপক ড. কেএম আমানত, এএফএম সাইফুল আমিন, টিআর হোসেন, এ কবির ও এমএ রউফ যৌথভাবে সেতুটির ফাটলের কারণ তুলে আনেন।

এতে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই এতে ফাটল দেখা দেয়। সেতুটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হুন্দাই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ১৯৯৭ ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আরপিটি-নাডিকো-বিসিএলের ১৯৯৯ সালের প্রতিবেদনে ফাটলের তথ্য উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া ২০০৬ সালে সেতুটি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা মার্গা নেট ওয়ান লিমিটেডের প্রতিবেদনেও ফাটলের তথ্য উল্লেখ করা হয়।

বুয়েটের প্রতিনিধিদলের পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৯৭ ও ১৯৯৯ সালের ফাটলগুলো পরবর্তীকালে বড় আকার ধারণ করেছে। ফাটলের মূল কারণ হলো সেতুটির নকশা প্রণয়নে ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড ৫৪০০ অনুসরণ করা হয়েছে। এতে যে তাপমাত্রা ও রডের সংকোচন-প্রসারণ ধরা হয়, তা ছিল অপর্যাপ্ত। ফলে অত্যধিক তাপমাত্রা ও ভারী যানবাহন চলাচল করায় বঙ্গবন্ধু সেতুতে ফাটল বেড়েছে ও এগুলোর আকার বড় হয়েছে।

এর পাঁচ বছর পর ২০১৫ সালের আগস্টে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সেতুবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে (আইএবিএসই-জেএসসিই জয়েন্ট কনফারেন্স ইন ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং-থ্রি) সেতুটির বিভিন্ন ধরনের সমস্যা নিয়ে আরেকটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এএফএম সাইফুল আমীন এবং জাপানের সাইতামা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল ও পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ওয়োশিআকি ওকুই যৌথভাবে গবেষণাপত্রটি প্রণয়ন করেন। এতে দেখানো হয় বঙ্গবন্ধু সেতুটি নির্মাণে ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করায় তাপমাত্রার পার্থক্যে কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে।

গবেষণাপত্রটির ‘সুপারস্ট্রাকচার: এফেক্ট অব টেমপারেচার’ অংশে দেশের বিভিন্ন সেতুতে তাপমাত্রার প্রভাব তুলে ধরা হয়। বঙ্গবন্ধু সেতু প্রসঙ্গে ওই অংশে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধনের আগেই এর কিছু অংশে ফাটল দেখা দেয়। মাঝের স্প্যানের উপরিভাগে এসব ফাটল সৃষ্টি হয়। সময়ের ব্যবধানে এগুলোর আকার বড় হয়েছে ও সংখ্যায় বেড়েছে। দুই বছর বিভিন্ন ঋতুতে সেতুর তাপমাত্রা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে বুয়েট দেখতে পায়, সেতুটির সুপারস্ট্রাকচার বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন রকমের তাপমাত্রা সহ্য করে। একই অবস্থা সেতুটির নিচের পৃষ্ঠে।

দিনে ও রাতে বঙ্গবন্ধু সেতু বিপরীতমুখী তাপমাত্রা সহ্য করে থাকে। গ্রীষ্মকালে এর পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এ সময় নকশার চেয়ে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রা থাকে সেতুটির উপরিভাগে। তবে হঠাৎ বৃষ্টি এলে তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি পর্যন্ত হ্রাস পায়। তবে সেতুটির নিচের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা তখনও অপরিবর্তিত ছিল। ১৯৯৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এর চেয়েও খারাপ পরিস্থিতির শিকার হয় সেতুটি।

এদিকে অতিরিক্ত তাপমাত্রার জন্য বঙ্গবন্ধু সেতুর ফাটল মেরামতের কাজ কয়েক দফা ব্যাহত হয়। ফাটলে লাগানো আঠাও উঠে যায়। এতে বন্ধ রাখা হয় ফাটল মেরামত। পরে সেতুটি মেরামতের সময় নতুন কিছু প্রযুক্তি ব্যবহারের সুপারিশ করে বুয়েট। এর পর সেতুটি মেরামত করা হয়।

অধ্যাপক ড. সাইফুল আমীন বলেন, ফাটল মেরামত কয়েক দফা ব্যর্থ হওয়ার পর নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এর পর সেতুটির মেরামত সম্পন্ন করা যায়। এতে সেতুটির তাপ সহ্য করার ক্ষমতাও বেড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেতুতে ফাটলের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ ছিল মিটারগেজ নকশা প্রণয়ন করলেও পরবর্তীকালে ব্রডগেজ রেলপথ সংযোজন। এক্ষেত্রে সেতুটির একদিকে এঙ্গেল বসিয়ে ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ করা হয়। ব্রডগেজ ট্রেনের এক্সেল লোড মিটারগেজের তুলনায় অনেক বেশি। এতে মূল সেতুতে চাপ বেশি পড়ায় ফাটল দ্রুত বড় হয়।

বর্তমানে বঙ্গবন্ধু সেতুতে সর্বোচ্চ ২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করে। এতে রাজধানীর সঙ্গে উত্তর-পশ্চিম এবং দক্ষিণ অঞ্চলের মধ্যে যাতায়াত করা ট্রেনগুলোর সেতুটি পাড়ি দিতে প্রায় আধা ঘণ্টা লেগে যায়। এছাড়া পণ্যবাহী ট্রেন চলাচলও বন্ধ সেতুটি দিয়ে। এতে আন্তর্জাতিক রেল করিডোর তথা ট্রান্স-এশিয়ান রেল রুটে বাধা হয়ে উঠেছে সেতুটি।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে যমুনা নদীর ওপর পৃথক রেল সেতু নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করে সরকার। সমীক্ষা ও বিস্তারিত নকশা প্রণয়নশেষে সম্প্রতি এর ঠিকাদার নিয়োগ প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। দ্রুতই এর নির্মাণকাজ শুরু করা হবে। আর ২০২৪ সালে সেতুটি উদ্বোধনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।