থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন অপচয় ও অপসংস্কৃতি

 

আলী ওসমান শেফায়েত: খ্রিষ্টবর্ষের সর্বশেষ রাতের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে উদযাপন করা হয় থার্টি ফার্স্ট নাইট নামের অশ্লীল সংস্কৃতি। নতুন বর্ষকে স্বাগত জানাতে সারারাত ধরে চলে নৃত্য, গান-বাজনা ও আনন্দ-উৎসব। নতুন ভোরকে বরণ করতে মানুষ বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠনের আয়োজন করে থাকে। কেউ মাখায় রং, কেউ ফোটায় পটকা-বোম, কেউ লাগায় রঙিন বাতি এবং কেউ-বা করে আতশবাজি। রং-বেরঙের আলোতে সারা আকাশ রঙিন করে তোলে। খুশির আমেজে, আনন্দের আতিশয্যে শিশু-কিশোর-যুবারা জয়ধ্বনি তোলে। এভাবেই নাচ-গান, হই-হুল্লোড় ও নানা আয়োজনে একটি রাত পার করে।

এক সময় এ সংস্কৃতি কেবল অমুসলিমরা পালন করলেও ক্রমশ তা মুসলিমদের সংস্কৃতিতেও জায়গা করে নিচ্ছে। বর্তমানে তো অমুসলিমদের চেয়ে নামসর্বস্ব মুসলিমরাই এ সংস্কৃতি পালনে অধিক অগ্রগামী, বেশি আগ্রহী। যাদের সংস্কৃতি, তাদের চেয়ে অন্যদের উচ্ছ্বাসই যেন বেশি! বিধর্মীরা যা করে, মুসলিমরা ঠিক তা-ই অনুসরণ করে। জন্ম সূত্রে মুসলিম পরিচয় ছাড়া বিধর্মীদের সঙ্গে তাদের কাজে বিশেষ কোনো পার্থক্য নজরে পড়ে না। বস্তুত শাশ্বত দ্বীনের ব্যাপারে অজ্ঞতা, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও বিজাতীয় সংস্কৃতির কুফল সম্পর্কে উদাসীনতার কারণেই উম্মাহর আজ এমন করুণ অধঃপতন।

নববর্ষ পালনের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দে সর্বপ্রথম মেসোপটেমীয় সভ্যতার লোকেরা নতুন বর্ষ উদযাপন শুরু করেছিল। তারা তাদের নিজস্ব গণনায় বছরের প্রথম দিন নববর্ষ উদযাপন করত। এর বেশি তাদের ব্যাপারে আর কিছু জানা যায় না। এরপর ব্যক্তি হিসেবে সর্বপ্রথম পারস্যের সম্রাট জামশেদের কথা জানা যায়, তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দে ‘নওরোজ’ নামে নববর্ষ পালনের প্রথা চালু করেছিল। প্রাচীন পারস্যের মূল ভূখণ্ড ইরানে এ ধারাবাহিকতা আজও বহাল আছে এবং ইরানে ‘নওরোজ’ (নতুন দিবস) ঐতিহ্যগত নববর্ষের জাতীয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে থাকে।

এরপর খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৩ অব্দে রোমে নববর্ষ পালন শুরু হয়। এর প্রায় একশ বছর পর খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ অব্দে সম্রাট জুলিয়াস সিজার ‘জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’ নামে একটি নতুন বর্ষপঞ্জিকার প্রচলন করে। তার সময়ে রোমে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার হিসেবে বছরের প্রথম দিনটিকে ঔধহঁং (জানুস) দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হতো। রোমানরা এ দেবতাকে ড়েফ ড়ভ নবমরহহরহমং বা শুরুর স্রষ্টা হিসেবে বিশ্বাস করত। এ দেবতার নামানুসারেই বছরের প্রথম মাসের নাম রাখা হয় ঔধহঁধৎু (জানুয়ারি)। এ মাস শুরু হলে তারা সেলিব্রেট করে তাদের দেবতা জানুসকে খুশি করে, যেন সে তাদের বছরটি মঙ্গলময় করে।

এটা হলো যিশু বা ইসা আ.- এর জন্মের আগে নববর্ষ পালনের ইতিহাস। ইসা আলাইহিস সালাম জন্মের পর তার জন্মের বছরকে সূচনাকাল ধরে ১৫৮২ সালে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি এই ক্যালেন্ডারের নতুন সংস্কার আনে, যা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। বর্তমানে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে দিনপঞ্জি হিসেবে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হয়ে থাকে। জুলিয়ান ক্যালেন্ডার ও আধুনিক গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসাব অনুসারে জানুয়ারি মাসের প্রথম তারিখ থেকেই শুরু হয় নতুন ইংরেজি বা খ্রিষ্টবর্ষের গণনা। এরপর ঊনিশ শতক থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘নিউ ইয়ার’ পালন শুরু হয়।

নববর্ষ পালন বিজাতীয় সংস্কৃতি ও বিধর্মীদের কালচার। এর সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। বস্তুত রোমের মুশরিক সম্প্রদায় ও পারস্যের অগ্নিপূজারী জাতি হলো নববর্ষ পালনের উদ্ভাবক। তাই একজন মুসলিম হিসেবে তাদের অনুসরণের কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া খ্রিষ্ট নববর্ষ পালনের সঙ্গে শিরকের সম্পৃক্ততা রয়েছে। কেননা, জানুস দেবতার নামে মাসের নাম ‘জানুয়ারি’ রেখে সেটার প্রথম তারিখকে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে উদযাপন করা হতো। তাই এ উৎসব থেকে মুসলিমদের বিরত থাকা জরুরি।

মুসলিম হিসেবে আমাদের এ বিশ্বাস থাকা অপরিহার্য যে, ইসলামে যা কিছু  বৈধ বা অনুমোদিত, তার সব কিছুতেই রয়েছে মানব জাতির সমূহ কল্যাণ ও নানাবিধ উপকার। পক্ষান্তরে ইসলামে যা কিছু হারাম বা নিষিদ্ধ, তার সব কিছুতেই রয়েছে মানব সম্প্রদায়ের জন্য সুনিশ্চিত অকল্যাণ ও বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি। যেহেতু আমাদের সবারই জানা যে, থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন ইসলামে নিষিদ্ধ, তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, এতে অনেক অকল্যাণ ও ক্ষতি রয়েছে।

থার্টি ফার্স্ট নাইটে অশ্লীলতার ব্যাপক সয়লাব ঘটে। এ রাতে এমন সব অশ্লীলতা প্রকাশ পায়, যা বছরের অন্যান্য সময়ে খুব কমই দেখা যায়। মফস্বলের তুলনায় শহরে অশ্লীলতার মাত্রা থাকে বেশি। শহরের অভিজাত ক্লাব, আবাসিক হোটেল ও বাসা-ফ্ল্যাটে রাতভর চলে অসামাজিক কর্মকাণ্ডের মহড়া। কী থাকে না এতে? বস্তুত যুবসমাজকে ধ্বংস করার জন্য যা দরকার, তার সবই থাকে এসব অনুষ্ঠানে। গান, বাজনা, ডিজে (উলঙ্গ নৃত্য), আতশবাজি, যুবক-যুবতীদের বাধাহীন উল্লাস, মাদকদ্রব্য সেবনসহ এমন সব কর্মকাণ্ডের আয়োজন করা হয়, যা তাদের বিভিন্ন অপকর্ম করতে প্রলুব্ধ করে।

থার্টি ফার্স্ট নাইটে অনেক তরুণীর সর্বনাশ ঘটে। অনেকে জেনে-বুঝে সর্বনাশা এ পথে পা বাড়ায়, আর কেউ-বা সরল বিশ্বাসে নিজের সর্বস্ব হারায়। সাময়িক উত্তেজনার মোহে কিংবা ভুল সিদ্ধান্তের খেসারতে শত শত মেয়ের ইজ্জত লুণ্ঠন হয়। আলট্রা মডার্ন শহুরে তরুণীটি এ রাতের অনুষ্ঠান উপভোগ করতে বের হয়ে বাসায় ফেরে অপবিত্রতার চিহ্ন গায়ে লাগিয়ে। মফস্বলের সহজ-সরল বালিকাটিও বান্ধবীদের কথায় অনুষ্ঠানে গিয়ে রাত শেষে ক্যাম্পাসে ফেরে ক্ষতবিক্ষত বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে। বস্তুত ভোগের লালসায় এ রাতে বখাটে ছেলেরা ফাঁদ পাতেÑহয়তো বন্ধুত্ব দেখিয়ে, নয়তো শক্তি খাটিয়ে।

থার্টি ফার্স্ট নাইটে চারদিকের হই-হুল্লোড় ও বিশৃঙ্খলায় রাতের নীরবতা ভেঙে খানখান হয়ে যায়। অসহনীয় শব্দদূষণ ও পটকাবাজির বিকট আওয়াজে শিশুদের ঘুম ভেঙে যায়। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে ওঠে সে আতঙ্কিত চোখে। অসুস্থ লোক বিছানায় উঠে বসে থাকে নীরব রাতের অপেক্ষায়। পরীক্ষার্থী ছাত্রের পড়া থমকে যায়। নির্ঘুম রাত কাটে তার পড়াহীন অবস্থায়। শেষ রাতে ধার্মিক বান্দার ইবাদতে ব্যাঘাত ঘটে। ইসলামি নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি তো আছেই, অন্যান্য দৃষ্টিকোণ থেকেও এভাবে মানুষকে কষ্ট দেয়াটা যে কতটা অমানবিক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না!

থার্টি ফার্স্ট নাইটে প্রচুর অর্থের অপচয় করা হয়। রঙের খেলা, আতশবাজি, পটকাবাজি, নাচ-গান, বিভিন্ন পদের খাবার, হোটেল বুকিং, আনন্দ শোভাযাত্রা, দলবদ্ধভাবে বাইক চালনা প্রভৃতির জন্য অপ্রয়োজনীয় প্রচুর অর্থ খরচ করা হয়। বিশেষ করে মেয়েদের জন্য অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করা হয়। ধনীর দুলালরা তো এসব অর্থ বাবার পকেট থেকে সহজেই সংগ্রহ করে, কিন্তু মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত ছেলেদের এটার জন্য অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। দুঃখের বিষয় হলো, কষ্টার্জিত এসব টাকা নিজের কল্যাণে ব্যয়িত না হয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ও নির্মল চরিত্র ধ্বংসের কাজে ব্যয়িত হয়।

থার্টি ফার্স্ট নাইট বর্তমানে যেভাবে ব্যাপকভাবে পালিত হচ্ছে, তার ক্ষতিকর প্রভাব শুধু আয়োজকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না; বরং এর উত্তাপ ধীরে ধীরে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। এমন বস্তাপচা সংস্কৃতি যত বেশি বিস্তার লাভ করবে, পরবর্তী প্রজন্ম তত বেশি ঝুঁকিতে পড়বে। এমন সংস্কৃতির কারণে তাদের মাঝে বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রহের জন্ম দেবে; ফলে নিশ্চিতভাবেই তারা বিধর্মীদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করবে এবং নিজেদের শাশ্বত দ্বীন, নির্মল চরিত্র ও সুস্থ সংস্কৃতিকে পুরোপুরিভাবে পরিত্যাগ করবে।

থার্টি ফার্স্ট নাইটের ইতিহাস এবং বর্তমান সময়ে এর অশ্লীলতা ও ক্ষতিকর দিকগুলো চিন্তা করলে খুব সহজেই বুঝে আসে যে, ইসলামে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনের কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া এতে বিধর্মীদের সাদৃশ্য, মানুষকে কষ্টদান ও অর্থের অপচয়সহ নানা নিষিদ্ধ বিষয় রয়েছে। থার্টি ফার্স্ট নাইটে এমন নিষিদ্ধ বিভিন্ন বিষয় থাকায় মুজতাহিদরা এটা উদযাপন করাকে অবৈধ বলেছেন। মুসলিমদের যারা থার্টি ফার্স্ট নাইট পালন করতে চায়, তারা নিষ্ঠাবান হলে যাচাই করে দেখতে অপসংস্কৃতি নিষিদ্ধ হওয়ার প্রমাণ আছে কি না।

থার্টি ফার্স্ট নাইটের অশ্লীলতা এখন ওপেনসিক্রেট, বিষয়টি কারও অজানা নয়। এ রাতে নারীরা ফিনফিনে পাতলা ও যৌন-উদ্দীপক পোশাকে বের হয়, আর পুরুষরা তা রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করে। অথচ এটা জাহান্নামি নারীদের বৈশিষ্ট্য। এ রাতে বিভিন্ন হোটেল ও ফ্ল্যাটে নারী-পুরুষ একত্র হয়ে এমন সব নোংরামি করে, যা ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য। অথচ একজন মুসলিমের জন্য সব ধরনের নোংরামি পরিহার করা ও অশ্লীলতাপূর্ণ সব উৎসব থেকে দূরে থাকা একান্ত জরুরি। অশ্লীলতা করা তো দূরে থাক; ইসলামের দৃষ্টিতে অশ্লীলতার প্রচার-প্রসার কামনা করাও জঘন্যতম অপরাধ ও হারাম।

আল্লাহ বলেন: ‘নিশ্চয়ই যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রচার-প্রসার কামনা করে, তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না।’ আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘জাহান্নামিদের দুটি শ্রেণিকে আমি (এখন পর্যন্ত) দেখিনি। একদল (পুরুষ) লোক, যাদের সঙ্গে গরুর লেজের মতো চাবুক থাকবে, তা দ্বারা তারা (সাধারণ) মানুষকে প্রহার করবে। আরেক দল নারী, যারা কাপড় পরিহিতা হয়েও বিবস্ত্র থাকবে। তারা (পাতলা পোশাক পরে পুরুষদের) আকর্ষণকারিণী হবে এবং হেলে-দুলে চলবে। (চুলকে স্টাইলিশ করে বাঁধা) তাদের মাথাগুলো (বড় কুঁজবিশিষ্ট) বুখতি উটের হেলে পড়া কুঁজের মতো হবে। ওরা জান্নাতে যেতে পারবে না, এমনকি তার সুগন্ধিও পাবে না; অথচ এত এত (অর্থাৎ অনেক) দূর হতেও তার সুঘ্রাণ পাওয়া যায়।’

ইসলামের দৃষ্টিতে মুসলিমদের উৎসবও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। আর স্বাভাবিকভাবেই ইবাদতের ধরন-পদ্ধতি প্রত্যেক ধর্মে ভিন্ন ভিন্ন। ইসলামে যেহেতু জাতিগতভাবে উৎসব পালনের জন্য কেবল দুটি দিবস নির্ধারিত রয়েছে, তাই এ দুটি দিবসের বাইরে উৎসব পালনের জন্য অন্য কোনো দিবস অনুমোদিত নয়। মুসলিমদের উৎসবের জন্য নির্ধারিত দিবস দুটি হলো, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। মুসলিমদের আনন্দ উদযাপনের জন্য এ দুটি দিবস আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বিশেষ উপহার। তাই অন্য জাতির উৎসব পালন থেকে বিরত থেকে মুসলিমদের জন্য নিজেদের উৎসবেই সন্তুষ্ট থাকা জরুরি।

আল্লাহ বলেন: ‘আমি প্রত্যেক জাতির জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছি (ইবাদতের) পদ্ধতি, যা তারা অনুসরণ করে। অতএব তারা যেন এ ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কিছুতেই তর্ক-বিতর্ক না করে।’ আনাস বিন মালিক (রা.) বর্ণনা করেন: ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মদিনায় উপস্থিত হলেন, তখন তিনি দেখতে পেলেন মদিনাবাসী (যাদের মধ্যে বিপুলসংখ্যক লোক আগেই ইসলাম গ্রহণ করেছেন) দু’টি জাতীয় উৎসব পালন করছে। আর তারা খেল-তামাসার আনন্দ-অনুষ্ঠান করছে। নবী করীম (সা.) তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা এই যে দু’টি দিন উৎসব পালন কর, এর মৌলিকত্ব ও তাৎপর্য কী? তারা প্রতি উত্তরে বলল, ইসলামের আগে জাহিলিয়াতের যুগে আমরা এ উৎসব এমনি হাসি-খেলা ও আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমেই উদযাপন করতাম, এখন পর্যন্ত তাই চলে আসছে। এ কথা শুনে নবী করীম (সা.) বললেন, ‘আল্লাহতায়ালা তোমাদের এ দু’টি উৎসবের দিনের পরিবর্তে তদপেক্ষা অধিক উত্তম দু’টি দিন ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা দান করেছেন। অতএব আগের উৎসব বন্ধ করে এ দু’টি দিনের নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানাদি পালন করতে শুরু কর।’

ইসলামে জাতীয়ভাবে দুটি উৎসবই নির্ধারিত। আর কুরআনের ভাষ্যমতে মুসলিমদের জন্য ইসলাম-অনুমোদিত উৎসবই শুধু বৈধ, অন্য জাতির উৎসব-পার্বণ পালনের কোনো অনুমতি নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় এসে প্রথমেই যেসব কুসংস্কৃতি বন্ধ করেন, সেগুলোর অন্যতম ছিল নববর্ষ উদযাপন। তিনি উৎসব পালনের জন্য এটার পরিবর্তে দুটি দিবস নির্ধারণ করে দেন। অতএব, বিধর্মীদের উদযাপিত নববর্ষের পরিবর্তে ইসলাম-প্রদত্ত দুটি দিবস পেয়েও যারা সন্তুষ্ট নয়, তারা মূলত দ্বীনের পূর্ণতাকে অস্বীকার করে জাহিলিয়াতের দিকে ফিরে যেতে চায়।

বর্তমানে থার্টি ফার্স্ট নাইট নামে ইংরেজি নববর্ষ পালনের যে প্রচলন রয়েছে, তা বিজাতীয় অপসংস্কৃতি। সুতরাং মুসলিমদের জন্য থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন করা স্পষ্টতই বস্তাপচা রীতিনীতির সঙ্গে সাদৃশ্য অবলম্বন। অথচ ইসলামে ইবাদত ও উৎসব ইত্যাদির ক্ষেত্রে কাফিরদের সঙ্গে, বিশেষত ইহুদি-খ্রিষ্টানদের সঙ্গে সাদৃশ্য অবলম্বন করা থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। এমন ব্যক্তিকে মুসলিমদের কাতার থেকে বের করে অমুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত বলে হুমকি দেয়া হয়েছে।

ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি অন্য জাতির সঙ্গে (কৃষ্টি-কালচার, বিশ্বাস ও আমলে) সাদৃশ্যতা অবলম্বন করে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।’

আমর বিন শুআইব (রাহ.) থেকে তার বাবার সূত্রে দাদা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা. বলেছেন: ‘ওই ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে (মুসলিমদের বাদ দিয়ে) বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে। অর্থাৎ তোমরা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের সঙ্গে সাদৃশ্য অবলম্বন করো না।’

বিজাতীয় সংস্কৃতি পালন করা, বিধর্মীদের উৎসবে শরিক হওয়া এবং তা সমর্থন করা সুস্পষ্ট হারাম ও নাজায়িজ। অতএব, যারা থার্টি ফার্স্ট নাইট কিংবা এ ধরনের বিজাতীয় উৎসবে অংশগ্রহণ করবে, তারাও এক্ষেত্রে তাদের শ্রেণিভুক্ত বলে বিবেচিত যাবে।

থার্টি ফার্স্ট নাইটে প্রচুর অর্থ-সম্পদের অপচয় হয়। রঙের খেলা, আতশবাজি, পটকাবাজি, গান-বাজনা, ডিজে নাচ, বিভিন্ন পদের খাবার, হোটেল বুকিং, আনন্দ শোভাযাত্রা, দলবদ্ধভাবে বাইক চালনা ইত্যাদির মতো অনর্থক ও অপ্রয়োজনীয় খাতে প্রচুর অর্থ-সম্পদ ব্যয় করা হয়। বিশেষ করে পছন্দের মেয়েদের পেছনে সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করা হয়। অথচ অর্থের অপচয় ও অনর্থক কাজ থেকে বেঁচে থাকা একজন মুসলিমের একান্ত কর্তব্য। একজন প্রকৃত মুসলিম কখনও এসব অর্থহীন আনন্দ-অনুষ্ঠান ও শয়তানি কাজকর্মে লিপ্ত হতে পারে না।

আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘আর তোমরা খাও এবং পান করো, কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৩১)

আল্লাহ আরও বলেন: ‘নিশ্চয় অপচয়কারীরা হলো শয়তানের ভাই।’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত: ২৭)

আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘ব্যক্তির ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য হলো, অনর্থক বিষয় পরিত্যাগ করা।’

সুতরাং একজন মুসলিমের জন্য কোনো অজুহাতেই বিজাতীয় চেতনায় নববর্ষ পালনকে বৈধ বলার অবকাশ নেই। বছরের শেষ সময়ে এসে পাপের পাল্লা ভারী না করে বরং গত বছরের গুনাহের কথা মনে করে অনুশোচনা করা এবং  নতুন বছরে ওই ভুল না করার জন্য নিজের কাছে প্রতিশ্রুতি দেয়া উচিত। এছাড়া এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষের ঘুমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা, রোগীদের কষ্ট বাড়িয়ে দেয়া ও শিশুদের কচিমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা পুরোপুরিই অমানবিক। মুসলিম সমাজকে নোংরাকারী ও আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজš§কে ধ্বংসকারী এসব উৎসব নিষিদ্ধ হওয়াটা তাই যুক্তির নিরিখেও সঠিক। সুতরাং মুসলিমদের জন্য বিজাতীয় এসব উৎসবকে সর্বাত্মকভাবে বর্জন করে জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে  মহানবী সা.- র আদর্শ  অনুসরণের চেষ্টা করা একান্ত কর্তব্য।

শিক্ষক ও গবেষক

কুতুবদিয়া, কক্সবাজার

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০