থুসিডাইসিস ফাঁদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন!

আনোয়ারুল ইসলাম : বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দুটি দেশ চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় থেকে বিশ্ব মোড়ল হিসেবে একক আধিপত্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিকর প্রভাব ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশগুলোয় ব্যাপকভাবে প্রতিফলিত হয়। ফলে যুদ্ধোত্তর বিশ্বে ব্রিটেন নিজের আসন হারিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুরো বিশ্বে একমাত্রিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ২১ শতকের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দেয়ার মতো বড় প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ হলো চীন। দেশটি অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছে। এরই মধ্যে দেশ দুটি প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। চীনের উত্থানকে ঠেকানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানা ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে, যা সরাসরি চীনবিরোধী।

প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হচ্ছে থুসিডাইডিসের ফাঁদ। প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাসে এর উল্লেখ পাওয়া যায় গ্রিক ঐতিহাসিক থুসিডাইডিস থেকে। ‘থুসিডাইডিসের ফাঁদ’ এই পরিভাষাটি গ্রিক ঐতিহাসিক থুসিডাইডিসের নামেই নামকরণ করা হয়েছে। ২০১২ সালে আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গ্রাহাম টি এলিসন যখন গ্রিক ঐতিহাসিক থুসিডাইডিসের ‘ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঃযব চবষড়ঢ়ড়হহবংরধহ ডধৎ’ গ্রন্থ উদ্ধৃত করে বলেন, ‘কোনো প্রতিষ্ঠিত মহাপরাক্রমশালী শক্তিই চায় না যে অন্য কোনো নতুন উদীয়মান শক্তি তার কর্তৃত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠুক।’ এলিসন ঐতিহাসিক এরকম ১৬টি ঘটনা নিয়ে একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন, উদীয়মান শক্তি কোনো প্রতিষ্ঠিত মহাপরাক্রমশালী শক্তির জন্যে হুমকি হয়, এরকম ১৬টি অবস্থার মধ্যে ১২টি অবস্থার শেষ পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ যুদ্ধের মাধ্যমে।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি উদীয়মান ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রের মধ্যে বিশ্ব নেতৃত্বের আসন নিয়ে যে লড়াই হয়, সেটিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা থুসিডাইসিস ফাঁদ বলে উল্লেখ করেন। ইতিহাসে থুসিডাইডিস ফাঁদের মূল কথা হলো, যখন একটি উদীয়মান শক্তি একটি প্রতিষ্ঠিত শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে, তখন সংঘাত, যুদ্ধের হুমকি বা বিপদের আশঙ্কা তৈরি হয়। যেমন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে উদীয়মান দেশ হলো চীন এবং ক্ষয়প্রাপ্ত দেশ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মূলত এ ধারণাটি আপেক্ষিক।

থুসিডাইসিস ফাঁদের কথিপয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন দুটি দেশের মধ্যে সংঘাত থাকবে এবং উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সংঘাত থাকবে। আন্তর্জাতিকভাবে তাদের আলাদা আলাদা ব্লক সৃষ্টি হবে। ক্ষয়প্রাপ্ত রাষ্ট্রটি বেশি আক্রমণাত্মক হবে।

চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বিগত শতাব্দী থেকে বেশ নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে আমেরিকার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ছিল বন্ধুসুলভ। সেসময় আমেরিকা ও জাপানের মধ্যে ছিল অস্থিতিশীল সম্পর্ক। চীনের প্রতি জাপানের আক্রমণাত্মক অবস্থায় আমেরিকা চীনকে কাছে টানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চলাকালে যখন জাপান যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবার আক্রমণ করে, চীন তখন জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। পরে ১৯৬৬ থেকে ’৭৬ সালে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পর চীনে যখন কমিউনিজম প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তারা অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের প্রতি বেশি মনোযোগ দেয়। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে চীনকে ব্যবহার করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যেমন ১৯৭১ সালে পিংপং ডিপ্লোমেসির মাধ্যমে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ হয়। আমাদের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খুবই বন্ধুসুলভ ছিল। কিন্তু গত শতাব্দীর কতিপয় কারণ লক্ষ করলে দেখা যায়, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বদলে গেছে। চীন এখন অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের পাশাপাশি বিশ্ব রাজনীতিতেও নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে, যা আমেরিকার বিশ্ব নেতৃত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং কর্তৃক গৃহীত ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’ শীর্ষক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে চীন, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের প্রতি অন্যতম বাধা।

চীনের ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক প্রভাব রুখতে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলোÑচীনের চারপাশে ঘেরা রাষ্ট্রগুলোকে শক্তিশালী করা, কিংবা সেগুলোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আওতায় আনা। এই ঘেরাও নীতি স্নায়ুযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল।

রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও জাপানকে হটিয়ে চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। চীনের এই উত্থান অর্থনীতিতে বিশ্ব শাসন করা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করছে। তাই চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্ভাবনা পর্যবেক্ষণ এবং স্ট্র?্যাটেজিক পার্টনারশিপ অব্যাহত রাখার নীতি গ্রহণ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কারণ চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শগত দ্বন্দ্ব থাকলেও চীনের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে প্রায় ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে চীনে।

ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের উত্থানকে দমিয়ে রাখতে চায়। এজন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে ব্যবহার করছে। অনেক দিন থেকেই তারা চীনের বিরুদ্ধে প্রতিবাহিনী হিসেবে ভারতকে সহযোগিতা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। নিজেরা সরাসরি যুদ্ধে জড়িত না হয়ে তৃতীয় কোনো পক্ষ দ্বারা শত্রুকে ঘায়েল করা যুক্তরাষ্ট্রের পুরোনো কৌশল। এ অঞ্চলের চীনের অন্যতম মিত্র পাকিস্তান ও মিয়ানমার। বাংলাদেশ এ অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। কিন্তু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান নীতি গ্রহণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ের সঙ্গে সমানভাবে পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান করছে।

২০১৩ সালে চালু হওয়া চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অধীনে এই উদ্যোগগুলোকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়। সেই বছরের শুরু থেকে চীন দক্ষিণ এশিয়ায় বৃহৎ পরিমাণে বিনিয়োগ করতে শুরু করে এবং ২০২২ সালের মধ্যে এই বিনিয়োগের অঙ্ক প্রায় ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করে। তার পর থেকে, বিশেষ করে ২০১৭ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে।

চীনকে উদীয়মান শক্তি হিসেবে রুখতে যুক্তরাষ্ট্র কতিপয় দেশ নিয়ে কিছু জোট গঠন করেছে, যার মধ্যে আইপিএফ, অকাস ও কোয়াড অন্যতম। তাছাড়া চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্প রুখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। আসিয়ান তথা দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ, এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরের নৌ-উপস্থিতি বাড়ানোর ঘোষণা, ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি রোধ করা প্রভৃতি এখন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির আরেকটি অগ্রগণ্য দিক।

মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলোর অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাছাড়া এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোকে সামরিক সহায়তাও প্রদান করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র সৌদি আরব। বর্তমানে এ অঞ্চলেও চীনের প্রভাব লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে এবং ইরানের মধ্যকার চুক্তিতে মধ্যস্থতা করে চীন। সৌদি আরবের চীনের সঙ্গে সখ্য ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করছে। ১৯৭৪ সালের ৮ জুন সৌদি আরব ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার ৫০ বছরব্যাপী ‘পেট্রো ডলার চুক্তি’ আবার বহাল করেনি সৌদি আরব। এর মাধ্যমে সৌদি আরব ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ বছরের পেট্রোডলার চুক্তির অবসান হয়। সৌদি আরব বর্তমানে চীনের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।

চীনের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম দিক হলো বিশ্ব রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক, আধিপত্যের বিরোধিতা করা, বিশ্বশান্তি রক্ষা করা প্রভৃতি।

বর্তমানে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব থুসিডাইসিস ফাঁদের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। প্রাচীন যুগের এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যকার যুদ্ধের ভাবধারা বর্তমানে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতীয়মান হয়। উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সংঘাত বিদ্যমান, যদিও দেশ দুটির মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। চীন অধিকাংশ সময় সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে না। তাদের মধ্যকার বর্তমান স্নায়ুযুদ্ধ ভবিষ্যতে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ধাবিত করার মাধ্যমে থুসিডাইসিস ফাঁদের প্রয়োগ ঘটায় কি না, তা দেখার বিষয়।

শিক্ষার্থী

রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০