নজরুল ইসলাম: বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) দরপত্রে অংশগ্রহণ করে ভুয়া কাগজপত্র জমা দিয়েছিল মেসার্স থ্রি অ্যাঙ্গেল মেরিন লিমিটেড। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে। বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে বিআইডব্লিউটিএকে এ বিষয়ে চিঠিও দেয়া হয়। তবে অজ্ঞাত কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
যদিও কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাবে নিজেদের অপরাধ স্বীকার করেছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএর কিছু কর্মকর্তা কোম্পানিটিকে দায়মুক্তি দিতে উঠেপড়ে লেগেছে। এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া মেসার্স থ্রি অ্যাঙ্গেল মেরিন লিমিটেডের বিরুদ্ধে নদী এবং ভূমি দখলের অভিযোগও রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২১ সালের ১ এপ্রিল দুটি ২৪ ইঞ্চি কাটার সাকশন ড্রেজারসহ সহায়ক জলযান ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি সংগ্রহের জন্য দরপত্র আহ্বান করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। ‘৩৫টি ড্রেজার ও সহায়ক জলযানসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি সংগ্রহ এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এই দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে থ্রি অ্যাঙ্গেল মেরিন লিমিটেডসহ আরও দুটি কোম্পানি অংশগ্রহণ করে।
দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি ২০২১ সালের ১ নভেম্বর থ্রি অ্যাঙ্গেল মেরিন লিমিটেডকে নন-রেসপনসিভ হিসেবে বিবেচনা করে। কারণ প্রতিষ্ঠানটি অভিজ্ঞতার ভুয়া তথ্য ও সনদপত্র দাখিল করে। এতে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়।
থ্রি অ্যাঙ্গেল মেরিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ২০২১ সালের ১৮ ডিসেম্বর নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে বিআইডব্লিউটিএ’কে চিঠি দেয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রতিষ্ঠানটিকে কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠায় বিআইডব্লিউটিএ। নোটিসে বলা হয়, তাদের চুক্তিপত্র, অভিজ্ঞতার সনদ ও ভ্যাট-ট্যাক্সের কাগজপত্র সঠিক পাওয়া যায়নি, যা পিপিআর ২০০৮-এর ১২৭ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে পিপিএ-২০০৬-এর ধারা ৬৪(৩) এবং পিপিআর-২০০৮-এর ১২৭(৪) ও (৮) অনুযায়ী কেন ব্যবস্থা নেয়া হবে না, তা সাত কার্যদিবসের মধ্যে জানাতে বলা হয়।
কারণ দর্শানোর নোটিসের জবাবে ১০ ফেব্রুয়ারি থ্রি অ্যাঙ্গেল তাদের ভুল স্বীকার করে। তারা ‘সরল বিশ্বাসে’ ভুল করেছে দাবি করে ক্ষমাও চায়।
দরপত্র দলিল অনুযায়ী অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে ক্লাস ড্রেজার অথবা ক্লাস ভেসেল নির্মাণ কাজের জন্য চুক্তিতে ১৮০ কোটি টাকা বা চুক্তির প্রতিটিতে ৯০ কোটি টাকার কাজের অভিজ্ঞতা দাখিলের শর্ত ছিল। অভিজ্ঞতার সপক্ষে থ্রি অ্যাঙ্গেল মেরিন থেকে ইউনিকর্ন ফ্রেইট সার্ভিস লিমিটেডের সঙ্গে এমভি ইউনিকর্ন এক্সপ্রেস-১ এবং এমভি ইউনিকর্ন এক্সপ্রেস-২ নামের দুটি ২১২ টিইইউ কন্টেইনার ভেসেল তৈরির জন্য ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ করা সম্পাদিত চুক্তিপত্র ও কমপ্লেশন সার্টিফিকেট দাখিল করা হয়। কিন্তু ইউনিকন ফ্রেইট সার্ভিস লিমিটেড থেকে জানানো হয়, থ্রি অ্যাঙ্গেল মেরিনের দাখিল করা চুক্তিপত্র ও অভিজ্ঞতার সনদ জাল। তারা এ ধরনের কোনো ভেসেল থ্রি অ্যাঙ্গেল মেরিন থেকে কেনেনি।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি থ্রি অ্যাঙ্গেলকে অযোগ্য ঘোষণা করে। পাশাপাশি জালিয়াতির জন্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পিপিআর-২০০৮-এর আলোকে সুপারিশ দিতে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেন বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান। কমিটিতে ছিলেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের অর্থ বিভাগের পরিচালক (অর্থ) গোপাল চন্দ্র সাহা, অর্থবিভাগের উপপরিচালক (রাজস্ব) সাইফুর রহমান এবং বন্দর ও পরিবহন বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক সাইফুল ইসলাম।
কমিটি সুপারিশে জানিয়েছে, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি কোম্পানিটিকে অযোগ্য ঘোষণা করেছে বলে তাদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের প্রয়োজন হয়নি। সেজন্য পিপিআর-২০০৮-এর বিধি ১২৭-এর উপবিধি (৪)(গ) ধারা অনুসারে কোম্পানিটিকে শাস্তির সুপারিশ যৌক্তিক বলে কমিটি মনে করে না। তবে চুক্তি স্বাক্ষর না হলেও আলোচ্য ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার জাল সনদ ও অন্যান্য কাগজপত্র দাখিল করায় বিষয়টি শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে কমিটি মনে করে। সেজন্য কমিটি থ্রি অ্যাঙ্গেলকে ২০২১ সালের ১৩ জুলাই থেকে ৯ মাসের জন্য সব ধরনের দরপত্রে অংশগ্রহণ অযোগ্য ঘোষণা করা যেতে পারে বলে সুপারিশ করেছে, যা এরই মধ্যে শেষও হয়ে গেছে। অথচ পিপিআর-২০০৮-এর বিধি ১২৭-এর উপবিধি (৪)(গ) ধারা অনুসারে এক বছর অথবা অনধিক দুই বছরের শাস্তি দেয়ার কথা বলা রয়েছে। কিন্তু সেই বিধিকে উপেক্ষা করেছে সুপারিশ কমিটি।
মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা বলেন, কমিটির সুপারিশ সন্দেহের জš§ দিয়েছে। কোম্পানিটি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দরপত্রে জাল কাগজপত্র দাখিল করে বড় ধরনের অন্যায় করেছে। সেটিকে ধামাচাপা দিতে কমিটি অভিযুক্ত কোম্পানির পক্ষে সাফাই গেয়েছে। তাদের দায়মুক্তি দিতে নানা কূটকৌশল অনুসরণ করা হয়েছে, যা মোটেও কাম্য নয়। কমিটি অভিযুক্ত কোম্পানি থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়েছে কি না, সে বিষয়েও প্রশ্নের জš§ দিয়েছে। তা না হলে কমিটির সুপারিশে স্পষ্ট ও সরাসরি নির্দেশনা থাকত বলে মনে করেন তারা।
এ প্রসঙ্গে বিআইডব্লিউটিএর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সরল বিশ্বাসে ভুল হয় কীভাবে? এটা জালিয়াতি। থ্রি অ্যাঙ্গেল মেরিন লিমিটেড জেনে-বুঝে জালিয়াতি করেছে। তারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। আর এই প্রতারণাকে বৈধ করার অপচেষ্টা করছে বিআইডব্লিউটিএ।’
বিআইডব্লিউটিএর সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ব্যবস্থা নেয়ার জন্য গঠিত সুপারিশ কমিটি পেশাদারিত্ব দেখাতে পারেনি। তারা বলেছে, যেহেতু চুক্তি হয়নি তাই অপরাধও সংঘটিত হয়নি। কমিটি মূলত পিপিআরের ১২৭ ধারার ‘পেশাগত অসদাচরণ’ ও ‘অপরাধ’ দুটি বিষয়কে আমলে নেয়নি। তারা চুক্তি বাতিলকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। কমিটি আবার শাস্তির সুপারিশও করেছে। তবে এই শাস্তি ভূতাপেক্ষ, যা নজিরবিহীন। তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়ার আগেই শাস্তির মেয়াদ শেষ। কমিটি আসলে কার জন্য কাজ করেছে, তা সন্দেহের জš§ দিয়েছে।’
থ্রি অ্যাঙ্গেল মেরিন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। জালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এটা আসলে সরল বিশ্বাসে ভুল হয়েছে। টেন্ডার সাবমিটের সময় আমি দেশের বাইরে ছিলাম। যারা সাবমিট করেছিল, তারা একটা ভুল করেছিল। পরে আমরা ভুল স্বীকার করে নিই।’
জালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক শেয়ার বিজকে বলেন, ‘কমিটির সুপারিশ মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
এ প্রসঙ্গে সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) সাবেক মহাপরিচালক মো. ফারুক হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সরল বিশ্বাসে করা ভুল স্বীকার করলেও তার কোনো ভিত্তি নেই। পিপিআরের ১২৭ ধারার ৬৪ বিধির চারটি অপরাধের (দুর্নীতিমূলক কার্য, প্রতারণামূলক কার্য, চক্রান্তমূলক কার্য ও জবরদস্তিমূলক কার্য) কোনো একটিও সংঘটিত হলে শাস্তি পেতে হবে। সুপারিশ কমিটি এগুলো এড়িয়ে গেলেও আদালতে তা টিকবে না।’
থ্রি অ্যাঙ্গেল মেরিনের পক্ষে বিআইডব্লিউটিএ’র সাফাই!
