শাহ মুনতাসির হোসেন মিহান : এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলকে দক্ষিণ এশিয়া মহাদেশ বলা হয়। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানের সমন্বয়ে দক্ষিণ এশিয়া মহাদেশ আঞ্চলিকভাবে পরিবেষ্টিত। স্বাভাবিকভাবে প্রতিটি দেশের নিজস্ব দর্শন মতাদর্শ ও স্বাধীন সার্বভৌমত্ব অধিকার বিদ্যামান রয়েছে। সেই দর্শন, ভাবাদর্শ ওই দেশের মানুষগুলোর মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে ফুটে ওঠে; যা দেশগুলোর স্বতন্ত্র সত্তা বহন করে দেশীয় ও বৈশ্বিক মানচিত্রে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশের স্বকীয় অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি রয়েছে। সেগুলোকে কেন্দ্র করে দেশগুলোর কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
একটি সুশৃঙ্খল সামাজিক ব্যবস্থাপনা দেশের ভাবমূর্তি তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে বহির্বিশ্বে স্থাপন করতে বাড়তি উপযোগিতা তৈরি করে। যে কোনো দেশের তৃণমূল বা স্থানীয় পর্যায়ে সমস্যা হার কম থাকে তাহলে তা দেশের নিরাপদ অর্থনৈতিক মডেল স্থাপনে সুচারুভাবে অবতীর্ণ হয়। নিরাপদ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষার মডেল দেশের জিডিপি, জিএনপি যেমন বৃদ্ধি করে, তেমনি দেশের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা,মুদ্রা ও মূল্যস্ফীতির মধ্যকার দারুণ সমন্বয় সাধন করে এই কাঠামো ও পরিকল্পনা।
দক্ষিণ এশিয়ার সামাজিক কাঠামো ব্যবস্থা দেশগুলোর অর্থনীতিক সূচক, অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা এবং মানবাধিকার চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাস, পেশা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি চিরায়ত অবস্থানের খুব বেশি পরিবর্তন নেই। যার দরুন এই দেশগুলোর সমাজ ব্যবস্থাপনা ও জীবনযাপনের ধরন প্রায় সমমানের। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে শুরু করে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পর্যায়ের সমাজব্যবস্থা সময়ের পরিক্রমায় পরিবর্তন হয়েছে দেশগুলোর সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সক্ষমতা ও ভিত্তি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে জড়িত। একটি দেশের শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামো ব্যবস্থা দেশের প্রতিটি মানুষের মানবাধিকার চাহিদা পূরণ অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া শক্তিশালী সুনির্মিত অর্থনীতি দেশের অন্যান্য খাতগুলোকে সচল ও গতিশীল করে। এতে মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন বৃদ্ধির পাশাপাশি জীবনমানে আধুনিকায়নের মাত্রা আসে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের প্রধান দুটি খাত তৈরি পোশাক ও প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স)। আর মানুষের জীবিকা নির্বাহের প্রধান পেশা হচ্ছে কৃষি। মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির প্রধান একটি খাত হচ্ছে পর্যটন খাত। অন্যদিকে কৃষিকাজ, হস্তশিল্প, বস্ত্রশিল্প, উৎপাদন প্রভৃতি ভারতের অর্থনীতির প্রধান অংশ। আবার পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অর্থনীতর প্রধান খাত হচ্ছে কৃষি। তাই স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও জীবনমানের প্রধান খাত হচ্ছে কৃষি। তবে দেশভেদে ভিন্নতা বিরাজ করে।
কভিড মহামারি-পরবর্তী বিশ্ব এখন রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের খোলসে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ভৌগোলিকভাবে বিশ্ব রাজনীতিতে পশ্চিমাদের কাছে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতির গুরুত্ব অত্যধিক। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধ শুরু হয়। বিশ্ব রাজনীতির পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পরিলক্ষিত। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে পুরো বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। যার প্রভাবে জ্বালানি ও তেলের ঘাটতি সৃষ্টি হয়ে এই অঞ্চল এর দেশগুলোতে। এতে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ঘাটতি সৃষ্টির হয়েছে। এছাড়া নিত্যপণ্যের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম আগের তুলনায় সচল নয় বিধায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন ও সামাজিক সুরক্ষা ও ব্যবস্থাপনা আগের সময়ের তুলনায় চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া বিশ্ববাজারে মার্কিন ডলালের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধির ফলে মুদ্রার দরপতন হয়ে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পাচ্ছে। ফলে প্রতিটি দেশ তাদের অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য, সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। তবে বাস্তবতা বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক আর্থসামাজিক জীবনযাত্রা ও উন্নয়ন বাকি বিশ্বের দৃষ্টি পুরোপুরি কাড়তে পারেনি।
বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাজুক অবস্থানে রয়েছে দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। তাদের সামাজিক ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক খাতের অবস্থা শোচনীয়। আশঙ্কাজনকভাবে দেশটির মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাচ্ছে। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। সম্প্রতি দেশটিতে রনিল বিক্রমাসিংহে নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরও দেশটির জনগণ তেমন ভরসা পাচ্ছে না। বাংলাদেশে গত মে মাসে মুদ্রাস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৪২ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাওয়ায় জরুরি নয় এমন পণ্য আমদানি বন্ধ করতে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। পাকিস্তানে ও ইমরান খান সরকার পরিবর্তনের পর দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজমান রয়েছে। মে মাসের শেষ থেকে পাকিস্তানে জ্বালানির দাম প্রায় ৯০ শতাংশ বেড়েছে। পণ্যের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। জুন মাসে বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার ২১ দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। শ্রীলঙ্কার মতো পাকিস্তানেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। অতি মাত্রায় পর্যটন খাতের ওপর নির্ভরশীল দেশ মালদ্বীপে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সরকারি ঋণের পরিমাণ বাড়তে দেখা গেছে। এ ঋণের পরিমাণ তাদের জিডিপির তুলনায় ১০০ শতাংশের বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগ্যান বলছে, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে আছে মালদ্বীপ। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, মুনাফার হার বৃদ্ধি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, উচ্চমাত্রার ঋণ ও বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার মতো এসব বৈশ্বিক প্রতিকূলতা এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। মোদ্দা কথা, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাপনা গুরুতর সময় পার করছে।
বিশ্ব এখন অস্থিতিশীল এক পরিস্থিতির মধ্যে সময় অতিবাহিত করছে। যার ছাপ দক্ষিণ এশিয়া মহাদেশের লক্ষণীয়। এ পরিস্থিতিকে সামাল দেয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। প্রথমত. দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক উন্নয়ন সংস্থা সার্ককে ঢেলে সাজাতে হবে এবং কমিউনিটি এক্সচেঞ্জ নীতির মাধ্যমে প্রতিটি দেশে সার্কের কার্যক্রম গতিশীল করতে হবে। প্রতিটি দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধতার পরিচয় দিতে হবে। কর্মমুখী শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ গঠন নির্মাণ করে এ অঞ্চলে বেকারত্ব সমস্যা হ্রাস করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের বিশেষ পরিচর্যা ও পর্যবেক্ষণ বৃদ্ধি করতে হবে। প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সীমান্তজনিত সমস্যা সমাধানে স্বাস্থ্যকর সংলাপ আয়োজন করতে হবে। যাতে দুই দেশের মধ্যকার কূটনীতিক সম্পর্কের অবনতি না ঘটে। বিদেশ থেকে প্রবাসীদের রেমিট্যান্সকৃত অর্থ আনয়নে নিয়মনীতি কিছুটা শিথিল করতে হবে। যাতে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি সচ্ছল থাকে। আমদানি-রপ্তানির ব্যয় কমাতে উৎপাদনমুখী হয়ে পণ্য বৃদ্ধি করতে হবে। নিজেদের দেশের সীমাবদ্ধকৃত সম্পদের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করে দেশের অর্থনীতিতে ভারসাম্য তৈরি করতে হবে। প্রান্তিক পর্যায়ে শিক্ষার মান নিশ্চিত করা। জ্বালানি সাশ্রয়ে অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাছাড়া প্রতিটি দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক খাতগুলোকে গবেষণা নির্ভর করতে হবে। যাতে ভবিষ্যৎ উন্নয়নের পথরেখা রচিত হয় দেশগুলোয়। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার ঐক্য ও সম্প্রীতির ঝাণ্ডা উড্ডীন হবে বিশ্বব্যাপী। এর সুফল ভোগ করবে দক্ষিণ এশিয়ার সাধারণ মানুষ থেকে গোটা বিশ্ববাসী।
শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়