নিজস্ব প্রতিবেদক: দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সমষ্টিগত অগ্রগতির জন্য দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃসংযোগ বাড়াতে হবে। এ সংযোগ বাড়ানোর নানা কৌশল রয়েছে। সেসব কৌশল প্রয়োগ করার জন্য বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু সেসব উদ্যোগ খুব একটা সফল হয়নি। এর পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে, পারস্পরিক আস্থাহীনতা। এই আস্থাহীনতা দূর করে দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য সার্কেল মতো সংগঠনকে শক্তিশালী ও সক্রিয় করতে হবে।
রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল চতুর্দশ ‘দক্ষিণ এশিয়া অর্থনীতি সম্মেলন’-এর সমাপনী অনুষ্ঠানে এমন তথ্য দেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ এ সম্মেলনের আয়োজন করে।
রেহমান সোবহান বলেন, একসময় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃরেল সংযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে বিষয়ে দেশগুলো একমত হতে না পারায় সে উদ্যোগ আর সামনে এগোয়নি। তিনি উল্লেখ করেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বিবাদ আছে। কিন্তু সে বিবাদ উপেক্ষা করে তারা অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার করার মাধ্যমে নিজেদের সমৃদ্ধি ঘটিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায়ও এমন সম্ভাবনা ছিল। ১৯৬৫ সালের পর থেকেই অর্থনীতিবিদরা এ ধরনের সম্ভাবনার কথা বর্ণনা করে আসছেন। কিন্তু এ বিষয়ে উদ্যোগ মাঝে মধ্যে এগোয় আবার পিছিয়ে যায়। এর পেছনে মূল কারণ পারস্পরিক আস্থাহীনতা। বিশেষ করে নিরাপত্তাজনিত আস্থার সংকট থেকে দেশগুলো অর্থনৈতিক সংহতি প্রতিষ্ঠা করতে চায় না। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আগামী দিনে অর্থনীতিবিদদের পাশাপাশি নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে সংলাপের আয়োজন করতে হবে। এ ধরনের আলোচনার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক প্ল্যাটফর্ম লাগবে। সে ধরনের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থাকে (সার্ক) শক্তিশালী করতে হবে।
রেহমান সোবহান বলেন, অমর্ত্য সেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও অর্থনৈতিক ব্যক্তিবর্গের মধ্যে গণবিতর্কের মাধ্যমে নানা সমস্যার সমাধানের কথা বলেছিলেন বহু বছর আগে। আমরা এখনও সে কাজটাই করছি। এখানে দুদিনব্যাপী আলোচনায় বেশ কিছু সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা শুনলাম। আশা রাখি সামনের দিনে এসব সমস্যার সমাধান হবে এবং কীভাবে এসব সমস্যার সমাধানে আমরা কাজ করব, তার একটা দিকনির্দেশনা পাওয়া যাবে।
সিপিডির এই প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একাধিকবার ডিউটি ফ্রি কোটা ফ্রি বাজারের আলোচনা হয়েছে। এ ব্যবস্থা চালুও হয়েছে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিকতার কারণে এ উদ্যোগ খুব বেশি সফল হয়নি। এসব বিষয় নিয়ে পুনরায় আমাদের ভাবতে হবে। কাজ করতে হবে। সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করতে হবে।
এর আগে দুদিনব্যাপী সম্মেলনের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন সিডিপির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, দুদিনব্যাপী প্যানেল আলোচনায় মূলত দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়ন, সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পাশাপাশি আলোচনা হয়েছে উচ্চ প্রবৃদ্ধি, উন্নয়নে সুশীল সমাজের ভ‚মিকা, আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য এবং দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় চুক্তির বিষয়াদি নিয়ে। আমরা কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছি। ইতিপূর্বে নেয়া পদক্ষেপগুলো কেন বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি আরও বলেন, আঞ্চলিক উন্নয়ন ও আন্তঃবাণিজ্যের উন্নয়ন না হওয়ার পেছনে অন্যতম প্রধার কারণ ছিল ভৌগোলিক রাজনীতি, আঞ্চলিক যোগাযোগের জন্য তহবিল না থাকা, দেশগুলোর পরিকল্পনার অভাব, অবকাঠামোগত উন্নয়ন না হওয়া ইত্যাদি। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন বিনিয়োগ, পারস্পরিক সহযোগিতা ও এফডিআই প্রয়োজন বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) আবাসিক প্রতিনিধি স্টিফেন লিলার বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অপার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এর জন্য প্রয়োজন অবকাঠামোগত উন্নয়ন, পারস্পরিক সহযোগিতা, উন্নত যোগাযোগ ও বৈদ্যুতিক খাতের উন্নয়ন। আর এসব কিছু যদি করা যায় তাহলে দক্ষিণ এশিয়ার মোট দেশজ উৎপাদন ৮ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। তবে এর জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন রয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
পিতামাতারা মেয়েদের প্রতি বিনিয়োগ করতে চান না: নারীর ক্ষমতায়ন ও লৈঙ্গিক ক্ষমতায়ন শীর্ষক একটি অধিবেশনে আলোচনায় অংশ নিয়ে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশের নারীরা অনেক দূর এগিয়েছে শিক্ষা ও কর্মস্থানে অংশগ্রহণের দিক থেকে। তবে এখনও সমাজে বেশ কিছু সাংস্কৃৃতিক বিষয়াদি রয়েছে। যার কারণে নারীদের নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আমরা করোনাকালে দেখেছি, নারী শিক্ষার্থীরা বেশিরভাগই ঝরে পড়েছে। অনেকের বাল্যবিবাহ হয়েছে। আর এর পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ, মেয়েদের মা-বাবা তাদের সন্তানদের প্রতি এখনও বিনিয়োগ করতে চান না।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সমাজে যেসব নারী খানিকটা পিছিয়ে রয়েছে তাদের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে সহিংসতা। তারা ঘরে বাইরে সহিংসতার স্বীকার হয়েছে। তিনি আরও বলেন, নারীর কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বেড়েছে তবে তা অবৈতনিক কাজে বেশি। নারীরা উচ্চ বেতন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তেমন জড়িত হতে পারেনি। এখন তারা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশীল হতেও পারেনি। এ সময় তিনি বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করার পরামর্শ দেন।
জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা সঠিকভাবে সম্পন্ন করা প্রয়োজন: ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘জনস্বাস্থ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের অনেক ক্ষেত্রেই সফলতা রয়েছে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ মানসম্পন্ন চিকিৎসার অভাব। অন্যদিকে জনসংখ্যার তুলনায় ডাক্তার ও নার্সের অনুপাত অনেক কম; যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বিবেচনায় অনুপস্থিত। এদিকে আমাদের নজর দেয়া দরকার। আমার মনে হয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে আলোচনাও হয় সীমিত পরিসরে। সর্বোপরি করোনা-পরবর্তী সময়ের কথা যদি বলি, স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা কেবল বিবেচিত হয় যে জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা সঠিকভাবে সম্পন্ন করা প্রয়োজন। যেমন সমন্বিতভাবে শহরে ধৌত ব্যবস্থা করা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
জিল্লুর রহমান বলেন, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে জনস্বাস্থ্য সেবা উন্নত করতে বেসরকারি খাত শক্তিশালী ভ‚মিকা রাখতে পারে। স্বাস্থ্য কখনও সেকেন্ডারি বিষয় হিসেবে দেখা উচিত হবে না। এটা খুবই সংকটাপূর্ণ এবং গুরুত্ব দেয়ার মতো বিষয়। বিশেষ করে করোনা-পরবর্তী সময়ের ক্ষেত্রে। এটা অর্থনীতি, ক্ষমতা, অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ; যা অন্য যে কোনো বড় বিষয়ের মতো গুরুত্ব দিতে হবে। স্বাস্থ্য অনেক বড় বিষয়।
দুদিনব্যাপী এই সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ৬০০ জনের বেশি অংশগ্রহণকারী অংশ নেন। সম্মেলনে মোট ১৩টি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশ-বিদেশ থেকে ৭০ জনেরও বেশি বক্তা বক্তব্য দেন।