Print Date & Time : 26 June 2025 Thursday 5:44 pm

দক্ষিণ এশিয়ায় পিছিয়ে বাংলাদেশ

মেহেদী হাসান: নানা অনিয়ম আর বাছবিচারহীন ঋণে ব্যাংক খাতে বাড়ছে খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতি। ফলে ঝুঁকিতে পড়ছে এ খাত। ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিসহন ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক রীতিনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ২০১৫ সাল থেকে মূলধন পর্যাপ্ততা-সংক্রান্ত ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। তবে ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়নে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। ব্যাংকের ঝুঁকি ঠেকাতে মূলধন সংরক্ষণে দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ন্যূনতম ১০ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। এর পাশাপাশি অপ্রত্যাশিত ঝুঁকির ফলে উদ্ভূত ক্ষতি মোকাবিলায় বাফার মূলধন হিসেবে ২০১৭ সালে ব্যাংকগুলোর ন্যূনতম প্রয়োজনীয় মূলধন ১০ শতাংশের অতিরিক্ত আরও এক দশমিক ২৫ শতাংশ অর্থাৎ মোট ১১ দশমিক ২৫ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণের আবশ্যকতা রয়েছে, যা ২০১৯ সালে সর্বমোট ১২ দশমিক ৫০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। তবে ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণে এগিয়ে যেতে পারছে না বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে ২০১৬ শেষে পাকিস্তানের মূলধন সংরক্ষণের হার ১৬ দশমিক দুই শতাংশ। ২০১১ সালে দেশটির ব্যাংক খাতের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের হার ছিল ১৪ দশমিক এক শতাংশ। ২০১৬ শেষে শ্রীলঙ্কার মূলধন সংরক্ষণের হার ১৪ দশমিক তিন শতাংশ। ২০১১ সালে ছিল ১৪ দশমিক পাঁচ শতাংশ। মূলধন সংরক্ষণে একই ধারা বজায় রেখেছে এ দেশটি। ২০১৬ শেষে ভারতের মূলধন সংরক্ষণের হার ১৩ দশমিক তিন শতাংশ। ২০১১ থেকে এ হার বজায় রেখেছে ভারত। তবে মূলধন সংরক্ষণে সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। ২০১৬ শেষে বাংলাদেশের মূলধন সংরক্ষণের হার ১০ দশমিক আট শতাংশ। যেখানে ২০১১ সালে এ হার ছিল ১১ দশমিক চার শতাংশ। ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণ করলে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া উচিত হলেও ব্যাংক খাতের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে উল্টো পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যাসেল-৩ হলো আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থার একটি ধাপ। দেশের ব্যাংকগুলো ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়ন করতে পারলে বিদেশি বিনিয়োগসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাবে। এর একটা টাইম লাইন রয়েছে। তবে সে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারছে না বাংলাদেশ।
তিনি বলেন, ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যেতে হলে ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচকের উন্নতি করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর ওপর মনিটরিং আরও জোরদার করতে হবে। খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতিসহ অন্যান্য আর্থিক সূচকের উন্নতি করতে হবে। কিন্তু বর্তমানে ব্যাংক খাত একটু ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বড় ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ফলে ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়নে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো।
ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়নে বেসরকারি ব্যাংকগুলো কিছুটা এগিয়ে গেলেও লক্ষ্যমাত্রা থেকে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলো। ফলে সার্বিকভাবেই পিছিয়ে বাংলাদেশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধনে বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলো সক্ষমতার পরিচয় দিলেও পিছিয়ে পড়ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং ঊর্ধ্বমুখী শেণিকৃত ঋণের কারণে বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। ফলে প্রয়োজনীয় মূলধনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে মূলধনের ওপর চাপ পড়ছে।
তথ্যমতে, দেশের রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকে ২০১৩ সালে মূলধন সংরক্ষণের হার ছিল ১০ দশমিক ৮১ শতাংশ; ২০১৪ সালে তা কমে দাঁড়ায় আট দশমিক ২৬ শতাংশ; ২০১৫ সালে তা আরও কমে দাঁড়ায় ছয় দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং ২০১৭ সালের জুনে এসে মূলধন এ হার দাঁড়ায় ছয় দশমিক ৯৯ শতাংশে। রাষ্ট্র মালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংকে মূলধন সংরক্ষণের হার নেতিবাচক। ২০১৭ সালের জুন শেষে ঋণাত্মক ৩২ দশমিক ৭৬ শতাংশ। তবে বেসরকারি ব্যাংকগুলো ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণে সক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছে। ২০১৩ সালে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোয় মূলধন সংরক্ষণের হার ছিল ১২ দশমিক ৫২ শতাংশ। ২০১৭ সালের জুনে এসেও এ ধারা অব্যাহত রেখেছে এ খাতের ব্যাংকগুলো। এ সময় তাদের মূলধন সংরক্ষণের হার দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ১৮ শতাংশে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত ছয় মাসে (অক্টোবর ২০১৭-মার্চ ২০১৮) রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ছয় ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি বেড়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। ছয় মাসে সবচেয়ে বেশি তিন হাজার ৬১৪ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি বেড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের সোনালী ব্যাংকে। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির ঘাটতির পরিমাণ ছিল তিন হাজার ১৪০ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চ শেষে তা বেড়ে হয়েছে ছয় হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা। ঋণ প্রদানের নামে অর্থ লুট হওয়া বেসিক ব্যাংকে ঘাটতি বেড়েছে ৫৮৩ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি ছিল দুই হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চ শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ১০৬ কোটি টাকা। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতি রয়েছে বিশেষায়িত খাতের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে; যার পরিমাণ সাত হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি ছিল সাত হাজার ৫৪০ কোটি টাকা; ঘাটতি বেড়েছে ৩৯০ কোটি টাকা। ছয় মাসে জনতা ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১৭২ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১৮৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭৮ কোটি টাকা। এছাড়া রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেড়েছে ৭০ কোটি টাকা।