Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 9:47 pm

দক্ষ চীনা জনবল নিয়োগ করেনি ঠিকাদার, বিলম্বিত নির্মাণকাজ

ইসমাইল আলী: পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হচ্ছে ঢাকা থেকে মাওয়া, ভাঙ্গা ও নড়াইল হয়ে যশোর পর্যন্ত রেলপথ। ২০২২ সালে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা থাকলেও তা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে আছে। মূলত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (সিআরইসি) প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত চীনা দক্ষ জনবল নিয়োগ করেনি। অন্যান্য পদেও লোকবল নিয়োগে রয়েছে অপ্রতুলতা। আবার প্রয়োজনীয় মেশিনারিজও নেই প্রকল্পটির কাজে। সব মিলিয়ে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সন্তোষজনক নয়।

গত ৩১ মার্চ অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-চীন সরকারের যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের ১৫তম বৈঠকে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। এ সময় জানানো হয়, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পটির ৯৩ দশমিক ২৭ শতাংশ বাস্তবায়নের কথা ছিল। তবে বাস্তবে ৫৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

তথ্যমতে, প্রকল্পটির আওতায় ১৬৯ কিলোমিটার মূল রেলপথ ছাড়াও ৪৩ দশমিক ২২ কিলোমিটার লুপ লাইন ও তিন কিলোমিটার ট্রিপল লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ২৩ দশমিক ৩৮ কিলোমিটার এলিভেটেড (উড়াল) রেলপথ, ৫৮টি মেজর ও ২৭৪টি মাইনর সেতু নির্মাণ করা হবে। এছাড়া ২৯টি লেভেল ক্রসিং গেট, ১৪টি স্টেশন নতুন নির্মাণ ও ছয়টি আধুনিকায়ন এবং ১৭টি স্টেশন বিল্ডিং নির্মাণ করতে হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দুই হাজার ৪৬৪ একর জমি অধিগ্রহণ এবং ১০০টি ব্রডগেজ কোচ কেনা হবে।

বৈঠকে জানানো হয়, প্রকল্পটির আওতায় অগ্রাধিকারভুক্ত সেকশন ছিল মাওয়া-ভাঙ্গা। এ অংশটি ৯১৩ দিনে নির্মাণের কথা ছিল। তবে এক হাজার ২৭৪ দিন পেরুলেও বাস্তবায়িত হয়েছে ৭৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। ঢাকা-মাওয়া সেকশনটি নির্মাণের কথা ছিল এক হাজার ৩৬৬ দিনে। এ পর্যন্ত ওই অংশটির কাজ হয়েছে ৫৩ শতাংশ। আর ভাঙ্গা জংশন থেকে যশোর পর্যন্ত সেকশনটি এক হাজার ৬৪৩ দিনে বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। এ পর্যন্ত ওই অংশের কাজ হয়েছে ৪৮ শতাংশ। এছাড়া যাত্রীবাহী কোচ কেনার অগ্রগতি হয়েছে ১০ শতাংশ।

ঢাকা-মাওয়া ও মাওয়া-ভাঙ্গা অংশের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। এর কারণে মূলত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পটির কাজে চীনা দক্ষ জনবল নিয়োগ করেনি। পাশাপাশি স্থানীয় শ্রমিক এবং কোয়ালিটি কন্ট্রোল প্রকৌশলী ও সেফটি অফিসারও প্রয়োজনীয় সংখ্যক নিয়োগ করেনি কোম্পানিটি। এছাড়া ভাঙ্গা-যশোর অংশে ব্যাচিং প্ল্যান্ট ও কনক্রিট ট্রাক নেই। প্রকল্প কর্তৃপক্ষ সিআরইসিকে মেশিনারিজ ও ইক্যুইপমেন্টের সংস্থান বাড়ানোর জন্য বারবার তাগাদা দিলেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না কোম্পানিটি।

জনবল ছাড়াও প্রকল্পটিতে রয়েছে জমি অধিগ্রহণ-সংক্রান্ত সমস্যা। দুই হাজার ৪৬৪ একর জমির মধ্যে দুই হাজার ৮০ একর অধিগ্রহণ করা হয়েছে, যার প্রায় পুরোটাই সিআরইসির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে ভাঙ্গা-যশোর সেকশনের নড়াইলে ১১ দশমিক ১০ একর জমি হস্তান্তর করা হয়নি। তবে দ্রুতই বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। বাকি জমিও অধিগ্রহণের প্রক্রিয়াধীন আছে। যদিও প্রকল্পটি বাস্তবায়ন বিলম্বের জন্য জমি অধিগ্রহণ বিলম্বকেই দায়ী করেছে সিআরইসি।

এদিকে ২০২০ সালে দেশে কভিড-১৯ সংক্রমণ শুরু এবং ২০২১ সালে দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়। এ অবস্থায় প্রকল্পটির কাজ শেষ করতে সংশোধিত কর্মপরিকল্পনা জমা দিয়েছে সিআরইসি। এতে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। যদিও চীনের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে সম্পাদিত ঋণচুক্তির মেয়াদ ২০২৪ সালের ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত। ফলে প্রকল্পটির কাজ ২০২৪ সালের মার্চের মধ্যে শেষ করার জন্য সিআরইসি’কে সংশোধিত কর্মপরিকল্পনা জমা দেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক আফজাল হোসেন বলেন, সিআরইসি চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, যারা বাংলাদেশের ফার্¯¡ ট্র্যাকভুক্ত একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে  রয়েছে। তাই আশা করা যায়, প্রতিষ্ঠানটি উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন জনবল প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য নিয়োগ করবে, যাতে সিআরইসির সুনাম বজায় থাকে। এছাড়া প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংস্থান করা ও সংশোধিত কর্মপরিকল্পনা অনুসরণে সিআরইসিকে নির্দেশনা দিতে চীন সরকারকে বৈঠকে অনুরোধ করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) ২০১৬ সালের ৩ মে অনুমোদন করা হয়। সে সময় এর নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৩৪ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ২২ মে সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদন করা হয়। সে সময় ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা (৪৯৭ কোটি ৭৪ লাখ ডলার)। আর প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সিআরইসির সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি সই হয় ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট। তবে চুক্তিটি কার্যকর হয় ২০১৮ সালের ৩ জুলাই। চুক্তিমূল্য ছিল ৩১৩ কোটি ৮৮ লাখ ডলার।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে ২৬৬ কোটি ৭৯ কোটি ডলার। ২০১৮ সালের ২৭ এপ্রিল এ চুক্তি সই হয়। বাকি ২৩০ কোটি ৯৫ লাখ ডলার বাংলাদেশ সরকার সরবরাহ করবে। আর প্রকল্পটির পরামর্শক হিসেবে যৌথভাবে কাজ করছে বাংলাশে সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। এ-সংক্রান্ত চুক্তি সই হয় ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটির নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর।