Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 10:14 pm

দক্ষ ধাত্রী: প্রসঙ্গ মা ও নবজাতকের মৃত্যুহার

আসাদুজ্জামান রিপন: নূরজাহানের বাড়ি থেকে শহর অনেক দূরে। আশপাশে কোনো হাসপাতাল নেই, ডাক্তারও নেই। নূরজাহান বলেন, ‘কোনো সমস্যা হলে আশপাশের লোকেরা যা কইছিল, তা-ই শুইনা ওষুধ খাইছি। ছাওয়াল হওয়ার সময়ও কাউরে পাই নাই। মা আর গ্রামের দাইমা ডেলিভারি করাইছে। এখন অনেক কষ্ট। বাচ্চা হওনের পর থেকে সারা শরীরে ব্যথা। শরীর সারাক্ষণ চুলকায়। খাবারে রুচি নাই। বাচ্চাটারও প্রতিদিন দুপুরে জ্বর আসে।’ হাসপাতাল অনেক দূরে হওয়ায় চট করে যাওয়া সম্ভব নয়। হাসপাতালে যেতে হলে রিকশা বা ভ্যানে করে যেতে হয়। রাস্তাও বেশি ভালো নয়। ভ্যানে করে গেলে ঝাঁকিতে যদি কোনো ক্ষতি হয়, সেকথা ভেবে ভয় পান নূরজাহান।

দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার মাহমুদপুর ইউনিয়নের মধ্যপাড়া গ্রামের গৃহবধূ নূরজাহান বেগম। আট বছর আগে তার বিয়ে হয় একই গ্রামের ক্ষেতমজুর মুশফিকের সঙ্গে। চার বছর বয়সী একটি ছেলেসন্তান রয়েছে নূরজাহানের। এক মাস আগে তিনি আরেকটি পুত্রসন্তান জš§ দেন। কিন্তু নূরজাহানের সন্তানের জš§ হয় বাড়িতেই। সন্তান প্রসবের সময় অভিজ্ঞ কোনো চিকিৎসক বা পেশাদার দাই ছিল না। গ্রামের স্বল্পশিক্ষিত এক দাই ও নূরজাহানের মা মিলে নূরজাহানের সন্তান প্রসব করান। নূরজাহান এখন প্রসবোত্তর নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন।

নূরজাহান জানান, হাতের কাছে ডাক্তার না থাকায় আগের বাচ্চাটা জন্মের পরপরই মারা গেছে। বিয়ের তিন বছরের মাথায় পেটে বাচ্চা এসেছিল। ডাক্তারও ছিল না, তাই কিছু বলতেও পারেননি নূরজাহান। হঠাৎ করেই ব্যথা উঠেছিল। সে সময় কাছে স্বামী, দাইমা, বা ডাক্তার কাউকে পাননি। দূর থেকে দাইমা আসতে আসতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। যে দাইমা এসেছিলেন তিনি অত ভালো ছিলেন না, তাই বাচ্চাটা হতে খুব কষ্ট হয়েছিল। বাচ্চাটা বাঁচেনি। বাচ্চা হওয়ার তিন দিনের মাথায় মারা গেল। এর পর থেকে নূরজাহান ভুগছেন। নূরজাহান এখন বোঝেন, ভালো ডাক্তার দেখাতে পারলে তিনি এত ভুগতেন না, আর বাচ্চাটাও বেঁচে যেত।

প্রকৃতপক্ষে নূরজাহানের গর্ভকালীন যত্ন-আত্তিও ভালো হয়নি। সন্তান গর্ভধারণের পর থেকে প্রসব হওয়া পর্যন্ত তাকে মাত্র একবার ডাক্তারের কাছে নেয়া হয়েছিল, আর সেটাও সন্তান প্রসবের অল্প কিছুদিন আগে। নূরজাহানের স্বামী ক্ষেতে কাজ করেন, তাই তার সময় নেই।

বাংলাদেশে মা ও শিশুমৃত্যুর হার আগের তুলনায় অনেক কমেছে। এখন প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৬৫ জন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্নত মানের মিডওয়াইফারি সেবা মা ও নবজাতকের মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে সহায়তা করবে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেন, দেশে মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে মিডওয়াইফরা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।

বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষিত নার্স-মিডওয়াইফরা এ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। বাংলাদেশে এখনও গ্রামাঞ্চলে অনেক অন্তঃসত্ত্বা মা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে এ সেবা গ্রহণ করছে না। অনেকে বাড়িতে অপ্রশিক্ষিত স্থানীয় ধাত্রী দিয়ে সন্তান প্রসব করাচ্ছে। ফলে অনেক মা ও নবজাতক স্বাস্থ্যসেবার সুফল পাচ্ছে না। সরকার এ ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৬৫ জনে নামিয়ে আনা। এবার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ৭০ জনে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে এ লক্ষ্য পূরণের জন্য অঙ্গীকার করেছে। আশা করা যায়, মানসম্মত মিডওয়াইফ নিয়োগের মাধ্যমে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।

প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার অনুযায়ী, বর্তমান সরকার এরই মধ্যে দুই হাজার ৯৯৬টি মিডওয়াইফারি পদ সৃষ্টি করেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬০০ পদের বিপরীতে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নতুন নিয়োগ পাওয়া মিডওয়াইফদের ভালো মানের সেবা দেয়ার জন্য প্রয়োজন কাজের অনুকূল পরিবেশ। পদগুলো যেহেতু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ইউনিয়ন সাব-সেন্টার পর্যায়ের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, সে কারণে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ জায়গায় অনুকূল পরিবেশ রয়েছে। তবে আরও উন্নত পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়াস সরকারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।

অতীতে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবায় পৃথক মিডওয়াইফ পদ ছিল না, ছিল না মিডওয়াইফ শিক্ষাব্যবস্থা। সরকারের সুদূরপ্রসারী দৃষ্টির কারণে স্বাস্থ্যসেবায় এই প্রথম মিডওয়াইফ পদ সৃষ্টি করা হয়। ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে থেকে দেশের ২০টি সরকারি নার্সিং ইনস্টিটিউট ও নার্সিং কলেজে পৃথক ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি কোর্স চালু করা হয়। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়েও এ কোর্স চালুর নীতিমালা প্রণয়নসহ অনুমোদন করা হয়েছে। বর্তমানে ৩৮টি সরকারি নার্সিং কলেজ ও ইনস্টিটিউটে এবং বেসরকারি ১৩টি নার্সিং কলেজ ও ইনস্টিটিউটে এ কোর্স চালু রয়েছে। পর্যায়ক্রমে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করা হবে। সরকারের পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় মিডওয়াইফারি শিক্ষার উন্নয়নে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। সম্প্রতি মিডওয়াইফারি শিক্ষায় মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে আরও উন্নত প্রশিক্ষণ ও উচ্চতর শিক্ষা নিশ্চিত করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

সরকার ২০১৮ সালের মধ্যে দেশের ৪২১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং এক হাজার ৩১২টি ইউনিয়ন সাব-সেন্টার পর্যায়ের জন্য মোট দুই হাজার ৯৯৬টি পদে মিডওয়াইফ নিয়োগ দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেছে। গ্রামীণ জনপদে মা ও নবজাতকের মৃত্যুহার তুলনামূলকভাবে বেশি। এ কারণে সৃষ্টি করা দুই হাজার ৯৯৬টি মিডওয়াইফ পদে ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে পদায়ন করা হয়েছে। দ্রুত মিডওয়াইফের সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তৃণমূল পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের যথাযথ মিডওয়াইফারি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আপৎকালীন ঘাটতি মোকাবিলা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ডিপ্লোমাধারী মিডওয়াইফদের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

মা ও নবজাতকের মৃত্যুর হার কমাতে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সরকারের পদক্ষেপের পাশাপাশি আমাদের আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও সেবার মানসিকতা। আমাদের সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হলে আমরা অবশ্যই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সমর্থ হবো।

পিআইডি নিবন্ধ