কাইমুল ইসলাম ছোটন, কক্সবাজার: কক্সবাজারের প্রধান নদী বাঁকখালী। কিন্তু দখল, দূষণ আর ভরাটের কবলে পড়ে নদীটি আজ মরতে বসেছে। নদী দখলের মহোৎসবে নেমেছে প্রভাবশালীরা এমন অভিযোগ স্থানীয়দের।
জানা যায়, কক্সবাজার শহরের সদর মডেল থানা থেকে প্রায় ৫’শ মিটার উত্তরে এক সময়ের বাণিজ্য কেন্দ্র বাঁকখালী নদীর কস্তুুরাঘাট এলাকা। নদীর অপর পাশে খুরুশকুল। মাঝখানে বাঁকখালী নদীর ওপর তৈরি হচ্ছে ৫৯৫ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতু। কিন্তু সেতু নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই শুরু হয়েছে নদী ও তীরের প্যারাবন দখল। প্যারাবনের নিধনের পরে বালু ফেলে নদী ভরাট করে প্লট বানিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এভাবে সংযোগ সড়কের পাশে প্রায় ৬’শ হেক্টর এলাকার প্যারাবন উজাড় করে তৈরি হচ্ছে শতাধিক ঘরবাড়ি সহ নানা স্থাপনা।
স্থানীয়রা জানান, বাঁকখালী কক্সবাজার জেলার প্রধান নদী। কক্সবাজারের অস্তিত্বের সঙ্গে বাঁকখালীর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কক্সবাজারের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই নদী। এ নদীর উপর জেলার ৭ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। কিন্তু জনগুরুত্বপুর্ণ এ নদীটি অবৈধভাবে দখল করে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলছেন প্রভাবশালীরা। আবার অনেকেই নদী ভরাট করে আবাসন প্লট তৈরী করে বিক্রিও করছে অনায়াসে। তাই সাধারণ জনগণের স্বার্থে যে কোন ভাবে এ নদীটি রক্ষা করার দাবি জানিয়েছেন জেলাবাসী।

জানা গেছে, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) এক রিট মামলার প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বাকঁখালী নদী দখলদারদের তালিকা তৈরী করে তাদের উচ্ছেদ ও দূষণের উৎস চিহ্নিত করে তা বন্ধের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি যেকোন উদ্দেশ্যে নদী ইজারা থেকে বিরত থাকতে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব, কক্সবাজারের ডিসিসহ ১০ সরকারি কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন।
তাছাড়া আদালত বাঁকখালী নদীকে কেন প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করতে নির্দেশ প্রদান করা হবে না বা কেন প্রাথমিক প্রবাহ ও সিএস জরিপ অনুযায়ী সীমানা নির্ধারণপূর্বক তা রক্ষা করার নির্দেশ প্রদান করা হবে না, অথবা কেন নদীর উভয় তীরের উপকূলীয় বন ফিরিয়ে আনার নির্দেশ প্রদান করা হবে না তা জানতে রুল জারি করে।
পরিবেশবাদী সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রণমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) এর প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট এলাকায় গত দুই মাসে প্রায় ৬’শ হেক্টর এলাকায় নদী দখল ও ভরাট করে ৪০ হাজার কেওড়া ও বাইনগাছ কেটে শতাধিক টিনের ঘর ও পাকা ভবন তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে। গাছপালা উজাড় হওয়ায় ২০৫ প্রজাতির পাখির আবাসস্থল ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে। এছাড়া নদীর অন্যান্য এলাকায়ও দখলও ভরাটের কারণে নদীর গতিপথ সংকোচিত হয়ে পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট দিয়ে একসময় চট্টগ্রামের সঙ্গে জাহাজ চলাচল ছিল। পৌরসভার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল কস্তুরাঘাট। এখান থেকে খুরুশকুল পর্যন্ত নদীর প্রস্থ ছিল দেড় কিলোমিটার। এই দেড় কিলোমিটার জুড়েই পানির প্রবাহ ছিল। দখল, দূষণ এবং ভরাটের কারণে এখন নদীতে পানির প্রবাহ আছে কোথাও ৪০০ মিটার, কোথাওবা ২০০ মিটার। ৫৯৫ মিটার দৈর্ঘ্যের সংযোগ সেতুর কাজ শুরুর পর থেকে নদীর বুকে সৃষ্ট প্যারাবন ও জলাভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে। তাই পরিবেশ বিধ্বংসী এসব কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক শেখ মো. নাজমুল হুদা বলেন, ‘বাকঁখালী নদীর প্যারাবন দখল ও ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে দুইটি মামলা হয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে। তবুও প্যারাবন দখল ও দূষণ বন্ধ করা যাচ্ছে না। নিয়মিত অভিযান চালানোর মতো পর্যাপ্ত লোকবল নেই বলে তিনি জানান।
এদিকে শুক্রবার সকালে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো: আমিন আল পারভেজ এর নেতৃত্বে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের একটি দল সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। এসময় তারা নদী দখল করে ভরাট ও প্যারাবনের গাছ নিধনের সত্যতা পান এবং উপস্থিত লোকজন ও দখলদারের পাহারাদারদের সাথে কথা বলে পরিবেশ বিধ্বংসী এসব কাজে জড়িতদের নামও পেয়েছেন বলে জানা যায়। এসময় জেলা প্রশাসনের দলের সাথে পরিবেশবাদী সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রণমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) এর প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল উল্লাহ মামুন উপস্থিত ছিলেন।
এ বিষয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো: আমিন আল পারভেজ বলেন, নদী দখল ও প্যারাবন নিধনের অভিযোগ পেয়ে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে সরেজমিন পরিদর্শন করতে এসেছি। পরিদর্শন করে নদী দখল করে ভরাট ও প্যারাবনের গাছ নিধন অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেছে। এছাড়া নদী দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হাইকোর্টের নিদের্শনাও রয়েছে। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে নদী দখলকারী ও প্যারাবনের গাছ নিধন করে স্থাপনা নির্মাণকারী এবং প্লট বাণিজ্যে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা নেয়া হবে। নির্মিত ও নির্মাণাধীন সকল স্থাপনা উচ্ছেদ হবে বলে তিনি জানান।