Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 11:13 pm

দণ্ড শুধু কি দেশি জেলেদের জন্য?

জাহিরুল ইসলাম: সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের কারণে এখন এটা সবার জানা প্রজনন মৌসুম সামনে রেখে চলতি মাসের প্রথম ২২ দিন বঙ্গোপসাগরসহ দেশের সব নদীতে ইলিশ মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতর। আইনে এ আদেশ অমান্যকারীর কী শাস্তির কথা বলা হয়েছে, সংস্থাটির বিভিন্ন প্রচারে উল্লেখ করা হয়েছে সেটিও। সরকারি প্রচারে বলা হচ্ছে আদেশ অমান্য করে ইলিশ আহরণ ও বিক্রি করলে সংশ্লিষ্টদের এক থেকে সর্বোচ্চ দুবছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে। নিষেধাজ্ঞা চলাকালে সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোকজন মাঠে কী কঠিন মনোভাব প্রদর্শন করে, তা আমরা অতীতে দেখেছি। এবার এখন পর্যন্ত সেরকম কোনো খবর অবশ্য নজরে আসেনি। প্রচারের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকরা যেমন মনোভাব দেখাচ্ছেন, তাতে ধারণা করা যায় নির্দেশ অমান্য করে কোনো জেলে এ সময় ইলিশ ধরতে সাগর বা নদীতে নামলে তাকে শাস্তি পেতে হবে।

সরকারের এমন মনোভাব দেখানোর সংগত কারণ অবশ্য রয়েছে। কিছুদিন আগে সাগরে জাল ফেলতেই ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ উঠত সেটা কিন্তু এরই ফল। আগের প্রজনন মৌসুমে সংশ্লিষ্টরা যদি কঠোর মনোভাব না দেখাতেন, তাহলে পরিস্থিতি ভিন্নরকম হতে পারত। নীতিনির্ধারকরা এখন ইলিশ রফতানির চিন্তা করছেন। দেশের বাজারে মাছটির যে দাম, এ অবস্থায় এমন কাজ করা ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে মতদ্বৈধতা রয়েছে। এ ইস্যুতে আলোচনা বর্তমান নিবন্ধের বিষয় নয়। তবে এটা ঠিক, বহির্বিশ্বে যেহেতু এ মাছের চাহিদা রয়েছে, তাই উৎপাদন যত বাড়বে এর রফতানিবিষয়ক আলোচনাও তত জোরালো হবে। কারণ তাতে রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রশ্ন। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎসগুলো যখন নানাভাবে সংকুচিত হয়ে আসছে, তখন এমন ভাবনা-চিন্তাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার কি উপায় আছে? বলা ভুল হবে না, আগের প্রজনন মৌসুমে প্রশাসন সজাগ না থাকলে এতদূর চিন্তা করতে পারতেন না নীতিনির্ধারকরা।

প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ রক্ষায় বাংলাদেশে যেমন জোর প্রচেষ্টা চলছে, প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমার সরকার সেরকম কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তাই এ সময় ইলিশ আহরণে গভীর সমুদ্রে যেতে বেগ পেতে হচ্ছে না দেশ দুটির জেলেদের। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা এটা অবগত কি না, জানা নেই। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের এমন কঠোর মনোভাবের সুযোগ নিচ্ছে প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের জেলেরা। বাংলাদেশের জলসীমার অন্তত ১১০ কিলোমিটার ভেতরে এসে ভারতীয় জেলেরা ইলিশ আহরণ করছে অবাধে। সমুদ্রসীমা লঙ্ঘন করছে মিয়ানমারের জেলেরাও। কোস্টগার্ড তাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পারছে না। প্রতিবেদনে এ অভিযোগও করা হয়েছে, নিজস্ব জলসীমায় ইলিশ আহরণের পাশাপাশি দস্যুবৃত্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের জেলেদের সর্বস্ব লুটে নেওয়াসহ হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে প্রতিবেশী দেশের মৎস্যজীবীরা। কোস্টগার্ড তাদের না করতে পারছে আটক, না দিতে পারছে দণ্ড। এতে মা ইলিশ রক্ষায় সরকারের লক্ষ্য যে শতভাগ অর্জন হচ্ছে না তা বলাই বাহুল্য।

প্রশ্ন উঠবে, দেশি জেলেদের ব্যাপারে সরকারের মনোভাব ‘কঠিন’ হলেও বাংলাদেশের জলসীমায় প্রতিবেশী দেশের জেলেদের ‘অনুপ্রবেশ’ ও ইলিশ আহরণ ঠেকানোর ব্যাপারে তারা নীরব কেন? এর সঠিক উত্তর আমরা জানি না। তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, প্রতিবেশী দেশের জেলেদের অনুপ্রবেশ ও ইলিশ আহরণ রোধে পদক্ষেপ যদি জোরদার করা না হয়, তাহলে বাংলাদেশি মৎস্যজীবীদের মধ্যেও সরকারি নির্দেশ লঙ্ঘনের প্রবণতা বাড়বে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, এতে তারাও যে টহলদার বাহিনীর নীরবতায় বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার আরও ভেতরে প্রবেশের স্পর্ধা দেখাবে সেটা সহজেই অনুমেয়।

এক সময় প্রতিবেশী দুই দেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ ছিল। এ-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের মাধ্যমে তার নিষ্পত্তি ঘটেছে কয়েক বছর আগে। এর মাধ্যমে দেশের স্থলভাগের চেয়েও বেশি অংশের সমুদ্রের ওপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের জলসীমার ১১০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে প্রতিবেশী দুই দেশের জেলেদের অনুপ্রবেশের খবরে মনে হচ্ছে আইনিভাবে সমুদ্রের কিছু অংশে সার্বভৌমত্ব আমরা পেয়েছি বটে; কিন্তু তার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারিনি। শুধু ইলিশ নয়, সমুদ্রবক্ষে থাকা অন্যান্য সম্পদ সুরক্ষায়ও যে এটা করা দরকার তা কি নীতিনির্ধারকরা জানেন না? সার্বভৌমত্ব অর্জনের মতোই এর সুরক্ষাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ভ‚খণ্ডের মতো জলসীমার ক্ষেত্রেও কথাটি প্রযোজ্য এটা তাদের মনে রাখতে হবে।

সমুদ্রসীমায় আইনি অধিকার যখন প্রতিষ্ঠা হলো বিশেষজ্ঞরা অবশ্য তখনই বলেছিলেন এর নিরাপত্তা রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে। সরকারের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল, এজন্য সময় লাগবে। তবে এ কথা বলা হয়তো ভুল হবে না সমুদ্রসীমার নিরাপত্তায় প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের তুলনায় আমরা এখনও রয়েছি অনেক পিছিয়ে। এখন হয়তো সক্ষমতায় ঘাটতি আছে, সেজন্য সমুদ্রসম্পদ আহরণে খুব একটা মনোযোগ দেখা যাচ্ছে না। এ অবস্থা অনন্তকাল থাকবে না। নিজ প্রচেষ্টা বা সহযোগী দেশের সহায়তায় বাংলাদেশ এক সময় মৎস্য-বহিভর্‚ত সমুদ্রসম্পদ আহরণে সক্ষমতা অর্জন করবে। নিজেদের জলসীমার সুরক্ষা নিশ্চিতের পাশাপাশি সেখানে ভিনদেশি নাগরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর অনুপ্রবেশ ঠেকাতে না পারলে সম্পদ আহরণের কাজটি কি কঠিন হয়ে পড়বে না? এমন পরিস্থিতিতে সেখানে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাও বেড়ে উঠতে পারে। এজন্য বাংলাদেশের উচিত চিহ্নিত জলসীমায় পর্যাপ্ত কোস্টগার্ড সদস্য নিয়োজিত রাখার পাশাপাশি টহল জোরদার করা। প্রযুক্তিগত সক্ষমতাও বাড়াতে হবে প্রয়োজনের তাগিদে ।

প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের ফল যে প্রতিবেশী দুই দেশও পায় সেটা সহজে অনুমেয়। তিন দেশ একই সময় ও সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করলে এর সুফল যে আরও বেশি পাওয়া যাবে, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এরকম কোনো উদ্যোগ বা প্ল্যাটফর্মের আওতায় কাঠামোগত পদক্ষেপ আছে কি না, জানা নেই। তবে সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে, এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। প্রতিটি দেশের জলসীমায় নিয়োজিত বাহিনী সতর্ক থাকলে অনুপ্রবেশের ঘটনা কমানো যাবে।

আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে বিধিবহিভর্‚তভাবে অন্য দেশের সীমানায় প্রবেশ দণ্ডনীয় অপরাধ। বাংলাদেশি জেলেদের কোনো ট্রলার গভীর সমুদ্রে ভুলবশত অন্য দেশের জলসীমায় প্রবেশ করলে তাদের শাস্তি পেতে হয়। সংশ্লিষ্ট দেশে বছরের পর বছর জেল খাটার নজিরও রয়েছে। প্রতিবেশী দেশের যেসব জেলে আইন ভেঙে বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করছে, তাদের কেন আমরা আনতে পারছি না শাস্তির আওতায়? এমন মনোভাব দেখাতে ব্যর্থ হলে সমুদ্রসীমা নিয়ে আমাদের উদাসীনতাই স্পষ্ট হবে। নিষেধাজ্ঞা চলাকালে এ ব্যাপারে আরও বেশি সজাগ থাকা উচিত এ কারণে যে, এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ।

প্রতি বছর সমুদ্র থেকে কী পরিমাণ ইলিশ আহরণ হচ্ছে, তার একটা হিসাব আছে মৎস্য বিভাগের কাছে। সমুদ্র থেকে আহরিত মৎস্যসম্পদ মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কী অবদান রাখে, সে হিসাবও আছে। কিন্তু প্রতিবেশী দেশের জেলেরা এ ধরনের কী পরিমাণ সম্পদ অন্যায়ভাবে নিয়ে যাচ্ছে সে হিসাব কি আমাদের আছে? সতর্কতা ও পাহারার মাধ্যমে এগুলো যদি রাখা যেত, তাহলে জিডিপিতে মৎস্যসম্পদের অবদান বাড়ত নিঃসন্দেহে।

অবকাঠামোগত কারণেই নদী ও সাগরে সমান তদারকি বজায় রাখা কঠিন। পরিস্থিতি দেখে মনে হয়, সংশ্লিষ্টরা এ সময় নদীতে যেমন তৎপরতা দেখান ততটাই ভুলে থাকেন সাগরকে। ইলিশ যেহেতু সাগর থেকে এসে নদীর মোহনায় ডিম ছাড়ে, সেহেতু এ ব্যাপারে সংগত কিছু যুক্তিও থাকতে পারে। তবে এটা মনে রাখতে হবে, সমুদ্র থেকে এ-জাতীয় সম্পদ আহরণ বাড়াতে হলে জেলেদের সঙ্গে এমন আচরণ করা যাবে না, যাতে তারা সমুদ্রে যাওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। এতে উপক‚লীয় অঞ্চলের বেশ কিছু পরিবারের জীবিকাও পড়বে হুমকির মুখে।

ইলিশ আহরণের ওপর যাদের জীবিকা নির্ভর করে, প্রজনন মৌসুমে তারা যাতে নদী বা সমুদ্রে না নামেন সেজন্য এ সময় তাদের কিছু সহায়তাও জোগায় সরকার। বাস্তবতা হলো, সহায়তা জুগিয়ে আমরা যদি নিজ দেশের জেলেদের ইলিশ আহরণ থেকে বিরত রাখি এবং জলসীমায় প্রয়োজনীয় প্রহরার ব্যবস্থা না করি, তবে প্রতিবেশী দেশের জেলেরা এ সুযোগ নিতে চাইবে স্বভাবতই। অনুপ্রবেশকারী ভিনদেশের জেলেদের যদি আইনের আওতায় আনা না যায়, তাহলে ক্ষুন্ন হবে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বাংলাদেশি যেসব জেলে নদী বা সাগরে নামেন, তাদের আইনের আওতায় আনা সহজ। ভিনদেশের জেলেদের যদি আমরা এর আওতায় আনতে ব্যর্থ হই, তাহলে অনেকে এ প্রশ্নও তুলবেন দণ্ড শুধু দেশি জেলেদের জন্য! সমুদ্রসীমার নিরাপত্তা নিয়ে যে দুর্বলতা স্পষ্ট হচ্ছে, সেটা কাটিয়ে উঠতে শিগগির যদি পদক্ষেপ না নিই, তাহলে এ ব্যাপারে প্রশ্নগুলো জোরালো হবে। ইস্যুটিকে নিছক প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ রক্ষার বিষয় হিসেবে দেখলে চলবে না, দেখতে হবে সমুদ্রসীমায় আমাদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা এবং ওখানে থাকা সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিতের বিষয় হিসেবেও। মা ইলিশ সুরক্ষা যেমন জাতীয় ইস্যু, সমুদ্রসীমার নিরাপত্তাও তার বাইরে নয়।

 

ব্যাংক কর্মকর্তা

zahirul.duÑgmail.com