দেশের পুঁজিবাজারে ‘শক্তিশালী’ হিসেবে চিহ্নিত ব্যাংকিং খাতের শেয়ারের অব্যাহত দরপতন শুধু বিনিয়োগকারী নয়, খোদ বাজারের জন্য দুঃসংবাদ। এর মধ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীরা যেমন লোকসানের শিকার হবেন, তেমনি বাজারের প্রতি অনাস্থাও বাড়বে তাদের। আমাদের শঙ্কা, এ অবস্থার উত্তরণ ঘটানো না গেলে এর সামগ্রিক প্রভাব পড়বে বাজারে এবং তা পরিস্থিতিকে করে তুলতে পারে অস্থিতিশীল। এজন্য শেয়ারের দরপতন ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর এগিয়ে আসা দরকার। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ধরে রাখতে নেওয়া চাই কার্যকর পদক্ষেপ। ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলে তা পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক নিম্নমুখী প্রবণতা ঠেকাতে সহায়ক হবে বলে মনে হয়।
বস্তুত এ ব্যাপারে কোনো ব্যাংককে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে এখনও দেখা যায়নি। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, বিদ্যমান পরিস্থিতি কি ব্যাংকগুলোর কর্তৃপক্ষের অজানা, নাকি তারা পদক্ষেপহীন রয়েছেন অন্তর্নিহিত কোনো কারণে? সত্য যে, নিকট অতীতে শেয়ারহোল্ডারদের উৎসাহব্যঞ্জক ডিভিডেন্ড দিয়েছে বেশকিছু ব্যাংক। এবার ডিসেম্বর হিসাব সমাপনীতেও ‘ভালো’ পরিচালন মুনাফা অর্জন করেছে সেগুলো। হিসাব চূড়ান্ত হওয়ার পর এর ভিত্তিতেই ঘোষিত হবে ডিভিডেন্ড। আমাদের ধারণা, এক্ষেত্রে এবারও গতবারের ধারা বজায় থাকবে। এ অবস্থায় আরও প্রশ্ন উঠবে, ব্যাংকগুলোর কর্তৃপক্ষ কি মনে করছে বিনিয়োগকারীর আগ্রহ ধরে রাখার জন্য বাড়তি হারে ডিভিডেন্ড ঘোষণাই যথেষ্ট? বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং খাতের শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা ব্যাপকভাবে পুঁজি হারালে তারা কি এখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন না? এ অবস্থা কি পুঁজিবাজারে খাতটির ভবিষ্যৎকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে না?
শেয়ারের অব্যাহত দরপতনের জন্য ব্যাংকিং খাতে সাম্প্রতিককালে সংঘটিত কিছু ‘অনাকাক্সিক্ষত’ ঘটনা যে দায়ী, তা উঠে এসেছে বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদনে। এতে দুর্বল হয়ে পড়েছে কোনো কোনো ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি। এ ধরনের ঘটনা গ্রাহকদের আস্থাতেই শুধু চিড় ধরায় না, এর প্রভাব পড়ে ব্যাংকের আয়ে; তাতে কমে যায় পরিচালন মুনাফা। এ কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয় ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের। খাতটিতে সাম্প্রতিককালে বড় ধরনের কেলেঙ্কারি হয়তো ধরা পড়েনি। তবে এটা মনে রাখতে হবে, আর্থিক খাতে ছোট ছোট দুর্নীতির ফল সামগ্রিকভাবে ‘বড়’ হয়ে ওঠে। এটি কিন্তু ধারাবাহিকভাবে ঘটেই চলেছে বিভিন্ন ব্যাংকে। সচেতন বিনিয়োগকারীরা যে এসব বিষয় নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এবং শেয়ার বাছাইয়ে বিবেচনায় রাখেন, তা বলা বাহুল্য। আমরা মনে করি, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখেই এ ধরনের দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যাংকগুলোর এগিয়ে আসা দরকার।
নিকট অতীতে সংঘটিত বিভিন্ন দুর্নীতি বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, খোদ ব্যাংকের কর্মকর্তা ও পরিচালকরা জড়িত রয়েছেন অনেক ক্ষেত্রে। প্রতিষ্ঠানে সিংহভাগ ক্ষেত্রে এসব লোকের দায়িত্ব যে রক্ষকের, তা কে না জানে! কিন্তু এরা যখন ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তখন তা প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে। এরও প্রভাব গিয়ে পড়ে ব্যাংকের পারফরম্যান্সে। ব্যাংকের শেয়ারের সাম্প্রতিক নিম্নমুখী প্রবণতার পেছনে ব্যক্তিবিশেষের কারসাজি রয়েছে কি না, খতিয়ে দেখা দরকার। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গেই তদারকি করতে বলবো আমরা। একটি মার্চেন্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেয়ার বিজকে জানিয়েছেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর স্বল্প উপস্থিতিই ব্যাংকিং খাতের শেয়ারের নিম্নমুখী দরের অন্যতম কারণ। অঘোষিত নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা এখানে বিনিয়োগ করতে পারছেন না বলেও জানিয়েছেন তিনি। সন্দেহ নেই, কাঠামোগত সমস্যা জিইয়ে রেখে পুঁজিবাজারে দীর্ঘ মেয়াদে স্থিতিশীলতা ফেরানো কঠিন। শক্তিশালী খাতটির ব্যাপারে এমন কোনো দুর্বলতা কাম্য হতে পারে না। বাজারটিতে ব্যাংক খাতকে ইতিবাচক ধারায় ফেরাতে কাঠামোগত এসব সমস্যা সমাধানের উদ্যোগও শিগগির নেওয়া হোক।
Add Comment