ইসমাইল আলী: বিদ্যুতের চাহিদা আশানুরূপ না বাড়ায় উৎপাদন সক্ষমতার বড় একটি অংশ বসে থাকছে নিয়মিতই। এজন্য ২০১৯ সালের শুরুর দিকে বেসরকারি খাতে নতুন আর কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স না দেয়ার সুপারিশ করে পাওয়ার সেল। যদিও বিদ্যুৎ খাতের নীতি গবেষণা সংস্থাটির এ পরামর্শ মানা হয়নি। উল্টো দরপত্র ছাড়াই বেসরকারি খাতে অনেকটা ডেকে এনে দেয়া হয় পাঁচটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স।
বাংলাদেশের ইউনাইটেড, সামিট, ইউনিক ও আনলিমা গ্রুপের পাশাপাশি এ তালিকায় রয়েছে ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপের আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার)। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। এমনকি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের আন্তর্জাতিক বাজারদরও যাচাই করা হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন, কোম্পানিগুলোকে নিজ উদ্যোগে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে প্রস্তাব জমা দেয়ার কথা জানানো হয়। ফলে সরাসরি প্রস্তাব দেয় কোম্পানিগুলো। তখন কোম্পানিগুলোর দেয়া প্রস্তাবের ওপর দরকষাকষি করে নির্ধারণ করা হয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয়, যার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয় ক্যাপাসিটি চার্জও। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারদর বিবেচনা করলে এ ব্যয় অর্ধেক পড়ত বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৯ সালে অনুমোদন দেয়া কেন্দ্রগুলোর নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছে অনেক বেশি। মূলত প্রায় এক দশক আগে অনুমোদন দেয়া বেসরকারি খাতের মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ভিত্তি ধরে এ ব্যয় নিরূপণ করা হয়। যদিও বৈশ্বিক মন্দাসহ নানা কারণে এক দশকে বিদ্যুৎকেন্দ্র যন্ত্রপাতির দাম ৫০-৬০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে বলে জানান পিডিবির প্রকৌশল বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
তারা বলেন, মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্রটির লাইসেন্স দরপত্রের মাধ্যমে দেয়া হয়েছিল। সে সময় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণব্যয় অনেক বেশি ছিল। কিন্তু ওই ব্যয়কে ভিত্তি ধরে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণব্যয় প্রাক্কলন কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। কারণ এক দশকে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণব্যয় অর্ধেকে নেমে গেছে। অথচ নতুন কেন্দ্রগুলোর নির্মাণব্যয় বেশি ধরায় ক্যাপাসিটি চার্জও পড়ছে বেশি। ২২ বছর এ ক্যাপাসিটি চার্জ বহন করতে হবে।
তথ্যমতে, ২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি অনুমোদন পায় ইউনাইটেড গ্রুপের বৃহৎ আইপিপি। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন সক্ষমতা ৫৯০ মেগাওয়াট। গ্যাস/এলএনজিচালিত কেন্দ্রটি ২০২৪ সালে উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। এর পরের মাসেই (১৪ মার্চ) চুক্তি করা হয় সামিটের ৫৮৩ মেগাওয়াটের আইপিপির জন্য। মেঘনাঘাটে নির্মাণাধীন দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক (এলএনজি/ডিজেল) বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে ২০২২ সালে।
২০১৯ সালের ২৫ জুন অনুমোদন পায় আনলিমা পাওয়ারের আরেকটি আইপিপি। মেঘনাঘাটে নির্মাণাধীন কেন্দ্রটির উৎপাদন সক্ষমতা ৪৫০ মেগাওয়াট। গ্যাস/এলএনজিভিত্তিক কেন্দ্রটি ২০২৪ সালে উৎপাদনে আসার কথা। ২০১৯ সালেন ২৪ জুলাই অনুমোদন পায় ইউনিক গ্রুপের ৫৮৪ মেগাওয়াটের আইপিপি। নারায়ণগঞ্জে গ্যাস/এলএনজিভিত্তিক কেন্দ্রটি নির্মাণাধীন ২০২২ সালে উৎপাদনে আসার কথা।
একইভাবে ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর অনুমোদন পায় ভারতের রিলায়েন্স পাওয়ারের মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্র। ৭১৮ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটি বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আইপিপি। এ কেন্দ্রটিও ২০২২ সালে উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। সব মিলিয়ে দুই হাজার ৯২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্র উৎপাদনে আসবে কয়েক বছরের মধ্যে।
সূত্র জানায়, ২০১৯ সালে লাইসেন্স দেয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মাসিক ক্যাপাসিটি চার্জ ধরা হয়েছে কিলোওয়াটপ্রতি গড়ে ১২ দশমিক ৩৫ ডলার। এ হিসাবে প্রতি মেগাওয়াটের মাসিক ক্যাপাসিটি চার্জ পড়বে ১২ হাজার ৩৫০ ডলার ও বছরে এক লাখ ৪৮ হাজার ২০০ ডলার। এতে প্রতি মাসে মেগাওয়াটপ্রতি ক্যাপাসিটি চার্জ পড়বে দেশীয় মুদ্রায় প্রায় এক কোটি ২৬ লাখ টাকা। যদিও দরপত্রের মাধ্যমে লাইসেন্স দেয়া হলে এ ব্যয় ৭০ লাখ টাকার বেশি হতো বলে মনে করেন পিডিবির কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন শেয়ার বিজকে বলেন, ২০১৯ সালে বিশেষ পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। তবে আপাতত বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। আগামীতে লাইসেন্স দেয়া হলে অবশ্যই দরপত্রের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেয়া হবে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভারতের রিলায়েন্সের বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জ পড়বে বছরে প্রায় ৯০৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। একইভাবে বাংলাদেশের ইউনাইটেডের বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ পড়বে বছরে প্রায় ৭৪৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ইউনিকের কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ পড়বে বছরে প্রায় ৭৩৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা, সামিটের কেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জ পড়বে বছরে প্রায় ৭৩৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা ও আনলিমার বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জ পড়বে বছরে প্রায় ৫৬৭ কোটি টাকা। পাঁচ কেন্দ্রের মোট ক্যাপাসিটি চার্জ পড়বে তিন হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা।
ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, দরপত্র ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়ার প্রবণতা শুরু হয় ২০১০ সাল থেকে। সে সময় স্থাপিত রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নির্মাণব্যয় অনেক বেশি ধরা হয়। ফলে ক্যাপাসিটি চার্জও ছিল অনেক বেশি, যা বিদ্যুৎ খাতের বোঝা হয়ে ওঠে। সে চক্র থেকে এখনও বের হতে পারেনি বিদ্যুৎ খাত। এখন আবার আইপিপির নামে একই প্রক্রিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য যাচাই করে কেন্দ্রগুলোর নির্মাণব্যয় ও ক্যাপাসিটি চার্জ কমানো উচিত বলে মনে করেন তিনি।