অটোমেটেড ভেহিকল ইন্সপেকশন সিস্টেম স্থাপন

দরপত্র মূল্যায়নে বিআরটিএ’র বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ

ইসমাইল আলী: মোটরযানের ফিটনেস স্বয়ংক্রিয়ভাবে যাচাইয়ে অটোমেটেড ভেহিকল ইন্সপেকশন সিস্টেম স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সম্প্রতি এ প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। তবে প্রকল্পটির ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে বিআরটিএ’র বিরুদ্ধে।

সূত্র জানায়, একটি কোম্পানিকে কাজ দিতে দরপত্রে অযৌক্তিক কিছু শর্ত যুক্ত করা হয়েছিল, যাতে বাংলাদেশের অন্য কোনো কোম্পানি এ দরপত্রে এককভাবে অংশগ্রহণ করতে না পারে। আবার দরপত্রে অংশ নেওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে চারটিকে যোগ্য হিসেবে সংক্ষিপ্ত তালিকায় রাখা হলেও একটি কোম্পানি ছিল নামসর্বস্ব। বাস্তবে ওই কোম্পানির কোনো অস্তিত্বই নেই।

এর পরিপ্রেক্ষিতে দরপত্র মূল্যায়নে অনিয়মের লিখিত অভিযোগ আনে এতে অংশ নেওয়া ও সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকা দুই কোম্পানি। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়। যদিও তারা কোনো প্রতিকার পায়নি। আর অনেকটা পূর্ব নির্ধারিতভাবেই প্রকল্পের ঠিকাদার হিসেবে সিএনএস (কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেমস) লিমিটেডকে নির্বাচন করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু এ প্রকল্পেই নয়, বিআরটিএর পরিচালক (অপারেশন) শিতাংশু শেখর বিশ্বাস যেসব প্রকল্পের দায়িত্বে থাকেন সেগুলোর কাজই পায় সিএনএস সিস্টেম। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানটি বিআরটিএ’র ৮টি প্রকল্পের কাজ করছে যেগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বা আছেন শিতাংশু শেখর বিশ্বাস। এছাড়া সিএনএস প্রতিটি প্রকল্পেই একই জনবল নিয়োগ করছে। ফলে কাজের মানও হচ্ছে খারাপ। এরপরও এ প্রতিষ্ঠানটিকেই বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ দেওয়া হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অটোমেটেড ভেহিকল ইন্সপেকশন সিস্টেম স্থাপনে ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর দরপত্র (রিকোয়েস্ট ফর প্রোপোজাল তথা আরএফপি) আহ্বান করে বিআরটিএ। এতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের টিম লিডারের আইটি খাতে ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। অর্থাৎ এ শর্ত পূরণে টিম লিডারকে ১৯৮৯ সাল থেকে আইটি খাতে কাজ শুরু করতে হবে, যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অসম্ভব। কারণ দেশে আইটি খাতের যাত্রা শুরু হয়েছে মূলত ২০০০ সালের পর থেকে। তবে দরপত্রে অংশ নিতে আগ্রহী বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আপত্তিতে পরে তা কমিয়ে ২০ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়।

আবার দরপত্রে অপারেশন ম্যানেজারের যোগ্যতা চাওয়া হয়েছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি, যা কোনোভাবেই যানবাহনের ফিটনেসের সঙ্গে জড়িত না। এছাড়া অপারেশন ম্যানেজার ও অ্যাসিস্ট্যান্ট অপারেশন ম্যানেজার দুই পদেই পাঁচ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে। আর প্রতিটি পদের বিপরীতে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকারের শর্ত দেওয়া হয়েছে, যা সিএনএস ছাড়া অন্যরা পূরণ করতে পারবে না।

এদিকে আইটি-সংক্রান্ত কাজ হলেও ঠিকাদারের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার থাকার কোনো শর্ত দেওয়া হয়নি দরপত্রে। এছাড়া মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ারের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে দুই বছর কিন্তু সহকারী মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ারের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে পাঁচ বছরের। আবার কেন্দ্রীয় সার্ভারে মাত্র ৭ হাজার ৫০০ ইনটেল চিপের শর্ত দেওয়া হয়েছে। এতে পুরোনো তথা মেয়াদোত্তীর্ণ সার্ভার সরবরাহের সুযোগ রাখা হয়েছে দরপত্রে। এভাবে সিএনএসের সুবিধামতো দরপত্রের শর্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে দরপত্রে অংশ নেওয়া বেলটেক সিস্টেমসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, একটি কোম্পানি বাড়তি সুবিধা দেওয়ায় বঞ্চিত হয়েছে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। ফলে এ প্রকল্পের মাধ্যমে সীমিত পরিসরে হলেও বিদেশি বিনিয়োগ আসার যে সুযোগ তৈরি হয়েছিল তার পথ বন্ধ হয়ে গেছে।

এদিকে মন্ত্রী, সচিব ও সংসদীয় কমিটিতে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার না হওয়ায় সম্প্রতি দরপত্র মূল্যায়নে অনিয়মের অভিযোগে প্রধানমন্ত্রীর বরাবর চিঠি দিয়েছে এতে অংশ নেওয়া একটি কোম্পানি।

চিঠিতে বলা হয়েছে, বিআরটিএ ডিজিটালাইজেশনের প্রায় প্রতিটি কাজ (বিআরটিএ আইএস, অনলাইন ব্যাংকিং, আর্কাভিং, বিআরটিএ সার্ভিস পোর্টাল, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ভেহিকল ইন্সপেকশন সেন্টার) একটি প্রতিষ্ঠানকেই দেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে। এতে বিআরটিএ একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি হওয়ার পূর্ব লক্ষণ এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশিত এক প্রতিষ্ঠানকে বারবার কাজ না দেওয়ার নির্দেশনার সরাসরি লঙ্ঘন। এছাড়া ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একই কর্মীকে প্রতিটি প্রকল্পে দেখিয়ে বারবার বিল উত্তোলন এবং নি¤œমানের সেবা ও সরকারি অর্থের অপচয়, রেলওয়ে টিকিট সরবরাহে খারাপ সেবাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।

আবার ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি কাজের প্রকল্প পরিচালক অথবা দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির প্রধান ছিলেন বা আছেন বিআরটিএর পরিচালক (অপারেশন) শিতাংশু শেখর বিশ্বাস। তার অধীনস্ত বা মূল্যায়নকৃত সব প্রকল্পে মূল্যায়ন কমিটিকে নানা প্রভাবিত করে শুধু একটি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। একটি স্বাধীন সরকারি প্রতিষ্ঠানের একজনের অধীনে মূল্যায়নকৃত সব কাজ সবসময় একই প্রতিষ্ঠান পাওয়ার বিষয়টি বিস্ময়কর ও সুস্পষ্ট পক্ষপাতদুষ্ট।

চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, সম্প্রতি বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ ওই পরিচালকের অধীন স্বয়ংক্রিয়ভাবে যানবাহনের ফিটনেস যাচাইয়ের লক্ষ্যে একটি দরপত্র আহ্বান করে। এতে কর্মীর যোগ্যতা নির্ধারণে মাস্টার্স পাসের পর অবশ্যই কমপক্ষে ৩০ বছরের আইটি অভিজ্ঞতা, মেয়াদোত্তীর্ণ সার্ভার অন্তর্ভুক্তির সুযোগ রাখা, বাজেট বিষয়ে ভুল তথ্য দেওয়াসহ নানা অনিয়মের শুরু হয়। পরে অভিযোগের মুখে খুব অল্প কিছু শর্ত শিথিল করা হয়।

যদিও নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড সলিউশন লিমিটেডকে শতকোটি টাকার প্রকল্পে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করেন শিতাংশু শেখর বিশ্বাস। যদিও প্রতিষ্ঠানটি আরজেএসসিতে নিবন্ধিত নয়। অথচ দুবাই, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের ফিটনেস যাচাইয়ের কাজ করা প্রতিষ্ঠান আরাবিয়া গ্রুপকে ন্যূনতম পাস নাম্বার দেন ও কোরিয়ান আরটিএকে অযোগ্য ঘোষণা করেন। অন্যদিকে প্রকল্প পরিচালকের পছন্দের প্রতিষ্ঠান সিএনএসকে বেশি নাম্বার দেন, যাতে কার্যত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কোম্পানিটি কার্যাদেশ পায়।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে বিআরটিএর পরিচালক (অপারেশন) শিতাংশু শেখর বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, প্রকল্পটির দরপত্র মূল্যায়নে দুর্নীতির যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিবের কাছে বিষয়টির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। যোগ্য হিসেবেই সিএনএস কাজটি পেয়েছে। আর প্রস্তাবটি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিও অনুমোদন করেছে। মন্ত্রণালয় ও ক্রয় কমিটি কেউ এ বিষয়ে কোনো আপত্তি তোলেনি। তাই এসব বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অভিযোগের কোনো মানে হয় না। যদিও সিএনএসকে বারবার কাজ দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে বিআরটিএতে বর্তমানে সাতটি প্রকল্পের কাজ করছে সিএনএস। এগুলোর প্রতিটির সঙ্গে শিতাংশু শেখর বিশ্বাস কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিলেন। এর মধ্যে বিআরটিএ আইএস, বিআরটিএ পোর্টাল, অনলাইন ট্যাক্স টোকেন আদায় ও ফিটনেস ফি আদায়, ডিজিটাল আর্কাভিং সিস্টেম ও অটোমেটেড ভেহিকল ইন্সপেকশন সিস্টেম প্রকল্পের পরিচালক শিতাংশু শেখর বিশ্বাস। আর স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রকল্পের মূল্যায়ন কমিটির প্রধান ছিলেন তিনি। এ প্রকল্পে কাজ করছে লজিক ফোরাম নামের একটি প্রতিষ্ঠান, যা সিএনএসের মালিক মনিরুজ্জামান চৌধুরীর ভাগনে মোশতাক আহমেদ লিটনের কোম্পানি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০