মো. হাসানুজ্জামান পিয়াস: ঐতিহাসিক মোহাম্মদাবাদ শহরটি বর্তমানে বারোবাজার নামে পরিচিত। বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোর মধ্যে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজার অন্যতম। প্রাচীন এ শহরটি ঘিরে রয়েছে নানা স্থাপত্য ও দর্শনীয় স্থান। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর মাটি খুঁড়ে ১৫টির বেশি প্রাচীন নিদর্শন খুঁজে পেয়েছে এখানে। এর মধ্যে অধিকাংশই মসজিদ। অনুমান করা হয়, এসব প্রাচীন নিদর্শন প্রায় ৭০০ বছরের পুরোনো। ভ্রমণপিপাসুরা ঘুরে আসতে পারেন এ জনপদ থেকে। সাক্ষী হতে পারেন প্রাচীন কীর্তিগুলোর।
কিছু কথা
জনশ্রুতি রয়েছে, হজরত খানজাহান আলী (রহ.) ১২ জন সহচর নিয়ে এখানে আসেন। তখন থেকেই এ স্থানের নাম হয় ‘বারোবাজার’। যুদ্ধ কিংবা ভয়াবহ ভূমিকম্পে প্রাচীন শহরটি ধ্বংস হলেও হারিয়ে যায়নি এর নিদর্শনগুলো। তবে সময়নির্দেশক প্রমাণের অভাবে এ স্থানের সঠিক ইতিহাস নির্ধারণ করা কষ্টকর। বারোবাজারের মসজিদগুলোর সঙ্গে বাগেরহাটের কয়েকটি মসজিদের বেশ সাদৃশ্য রয়েছে।
১৯৮৯ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর এ এলাকা অনুসন্ধান করে ১৫টির বেশি ঢিবি আবিষ্কার করে। তখন মাটি খননের মাধ্যমে আবিষ্কার করা হয় কয়েকটি মসজিদ। তবে সে সময় গোড়ার মসজিদ ও সাতগাছিয়া মসজিদ ছাড়া আর কোনো কিছু সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পরে ১৯৯২-৯৩ সালে এলাকাটি পুনরায় জরিপ করা হয় এবং খননের মাধ্যমে বেশ কিছু মসজিদ আবিষ্কার হয়। সবগুলো মসজিদই প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরে জায়গা করে নেয়।
দর্শনীয় স্থান
এ শহরের চারপাশে প্রায় ১০ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে প্রচুর দিঘি, মাটির ঢিবি, সমাধিক্ষেত্র, কবরস্থান, বন্দর, লৌকিক ভবন ও প্রাচীন বেশ কয়েকটি মসজিদ। মসজিদগুলোর মধ্যে রয়েছে গলাকাটা মসজিদ, জোড়বাংলা মসজিদ, গোড়ার মসজিদ, সাতগাছিয়া মসজিদ, নুনগোলা মসজিদ, শুকুর মল্লিক মসজিদ, চেরাগদানি মসজিদ, সওদাগরের মসজিদ প্রভৃতি। এখানকার অধিকাংশ মসজিদের মেহরাব ও দেয়ালে নানা ধরনের পোড়ামাটির কারুকাজ দেখা যায়। যা মুসলিম স্থাপত্যের এক নয়নাভিরাম ও অনন্য উদাহরণ। এক বা একাধিক গম্বুজসহ সব মসজিদের পাশে একটি করে দিঘি রয়েছে। স্থানীয়দের মতে, পুরো বারোবাজারজুড়ে ১২৬টি জলাশয় ছিল। অবশ্য অধিকাংশ জলাশয়ের অস্তিত্ব বর্তমানে নেই। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু দিঘি হলো রাজমাতার দিঘি, সওদাগর দিঘি, পীর পুকুর, চেরাগদানি দিঘি, গলাকাটার দিঘি, ভাই-বোন পুকুর, পাঁচ পীরের দিঘি ও শ্রীরাম রাজার দিঘি।
বারোবাজারে রয়েছে গাজী কালু-চম্পাবতীর কবর। কবরগুলোয় কোনো শিলালিপি নেই। তবে এগুলো যে তিনজন বিশিষ্ট মহাত্মার সমাধি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কবরগুলোকে হাল আমলে সংস্কার করে গাজী কালু ও চম্পাবতীর কবর বলে চিহ্নিত করা হয়েছে আরবি অক্ষরে সিমেন্ট পলেস্তারার ওপর নাম খোদিত করে। লোকমুখে শোনা যায়, এখানে আগে প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে গাজীর ব্যাঘ্রকুলের আগমন ঘটত। এখন আর তা হয় না। কারণ জঙ্গলের অভাবে বাঘের আবাসভূমির অভাব দেখা দিয়েছে।
বারোবাজার থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে রয়েছে মারজাত বাঁওড়। একে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাঁওড় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এখানে অতিথি পাখির আনাগোনা চোখে পড়ে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা বাঁওড়টি যেন দর্শনার্থীকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। বাঁওড়ে নৌকা ভ্রমণও করে আসতে পারেন।
কীভাবে যাবেন
রাজধানী থেকে খুব সহজে এখানে যাওয়া যায়। যশোর থেকে বারোবাজারের দূরত্ব ১৭ কিলোমিটার। রাজধানী থেকে বিভিন্ন পরিবহনের এসি ও নন-এসি বাসে চড়ে সরাসরি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলায় পৌঁছানো সম্ভব। ঝিনাইদহ হয়ে কালীগঞ্জ যাওয়ার দূরপাল্লার বাসের মধ্যে রয়েছে ঝিনাইদহ লাইন, দর্শনা ডিলাক্স, চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স, রয়েল ও সোনার তরী। চাইলে ট্রেন কিংবা বিমানযোগেও যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে প্রথমে নামতে হবে যশোরে। সেখান থেকে সরাসরি বাস বা সিএনজি অটোরিকশায় বারোবাজার যেতে পারেন।