মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: পুরোনো বিনিয়োগকারী হাসান মাসুদ। ২০১০ সালের ধসের রেশ এখনও কাটেনি তার। সেজন্য আগের পোর্টফোলিও সমন্বয় করতে যাননি তিনি। জমানো চার লাখ টাকা নিয়ে কিছুদিন আগে সাজিয়ে ছিলেন নতুন পোর্টফোলিও। ভেবেছিলেন মাঝেমধ্যে কারেকশন হলেও এবার বাজারে ধস নামবে না। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে বদলে গেছে এ বিনিয়োগকারীর ধারণা। কারণ ইতোমধ্যে লোকসানে পড়েছেন তিনি। সংশোধনের বদলে ধস তার সব ভাবনাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। এ তো গেলো বিনিয়োগকারী হাসান মাসুদের কথা। বাজারের সাম্প্রতিক আচরণে আশাহত হয়েছেন এমন লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। এখন তারা বাজারে থাকবেন, না বেরিয়ে যাবেন এ নিয়ে দোটানায় পড়েছেন।
সাম্প্রতিককালের বাজার চিত্র লক্ষ করলে দেখা যায়, কিছুদিন আগে বাজার টানা ঊর্ধ্বমুখী ছিল। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০ ডিসেম্বর ডিএসইর প্রধান সূচক ছিল ৪ হাজার ৯৩১। এখান থেকে বাজারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা শুরু হয়। ২৪ জানুয়ারি সেই সূচক বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৭০৮ পয়েন্টে। অর্থাৎ ২৫ কার্যদিবসের মধ্যে মূল্যসূচক বাড়ে ৭৭৭ পয়েন্ট। গড়ে প্রতিদিন বৃদ্ধির গড় দাঁড়ায় ৩১.০৮ পয়েন্ট। এর পর থেকেই পুঁজিবাজারে পতন দেখা যায়। মাত্র সাত কার্যদিবসের ব্যবধানে সূচক ৫ হাজার ৭০৮ পয়েন্ট থেকে নেমে এসেছে ৫ হাজার ৩৬৫ পয়েন্টে। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে কমেছে ৩৪৩ পয়েন্ট। গড় করলে সূচক কমার পরিমাণ দাঁড়ায় দৈনিক ৪৯ পয়েন্ট। বাজার চিত্রানুযায়ী দেখা যায়, সূচক যে হারে বেড়েছিল, কমার পরিমাণ তার চেয়ে ১৮ শতাংশ বেশি। ফলে এমন দরপতনে খেই হারিয়ে ফেলেছেন বিনিয়োগকারীরা।
বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, বাজার কারেকশন বা শেয়ারের দর সংশোধন হবে এটা চেয়েছিলেন তারা। সেজন্য তারা মানসিকভাবে প্রস্তুতও ছিলেন। কিন্তু এর বদলে পুঁজিবাজারে ধস নেমে আসবে তারা এমন ভাবতে পারেননি। তারা অভিযোগ করেন, বাজারে আবারও খেলোয়াড়রা সক্রিয় হয়েছেন। তারাই বাজার নিয়ে খেলা করছেন। আর এ কারণেই বাজার তার স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে। বাজারের লাগাম টেনে ধরার জন্য তারা সংশ্লিষ্টদের নজরদারি বাড়ানোর আহ্বান জানান।
এ বিষয়ে কথা হয় বিনিয়োগকারী হিমায়েত আলীর সঙ্গে। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘অনেক আশা নিয়ে আবার পুঁজিবাজারে ফিরে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম এবার আমরা বাজার থেকে প্রতারিত হব না। কিন্তু এখন দেখছি ধারণা ভুল। প্রতিদিনই লোকসানের বোঝা ভারী হচ্ছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে পুঁজিবাজারে আবারও আগের মতো হয়ে যেতে পারে’ বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
একই প্রসঙ্গে বিনিয়োগকারী শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘একটি চক্র আবারও বাজার নিয়ে কারসাজি শুরু করেছে। তারা শেয়ারের দর বাড়িয়ে বিক্রি করে দিয়ে বাজার থেকে বের হয়ে যায়। আর শেষ পর্যন্ত এর ভোগান্তি পোহাতে হয় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের।’ তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাজারের আগের অবস্থা আর এখনের অবস্থার মধ্যে খুব একটা ফারাক নেই।’
অন্যদিকে বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করলে বাজারসংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। কেউ কেউ বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক বললেও অনেকে এটাকে অস্বাভাবিক অ্যাখা দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারি ২০১০-এর তদন্ত কমিটির প্রধান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘কয়েক দিন আগে বাজারের যেভাবে উত্থান হয়েছিল, তা স্বাভাবিক ছিল না। আর এখন যেভাবে সূচকের পতন ঘটছে সেটাকেও স্বাভাবিক বলা যায় না।’
তিনি বলেন, ‘মাঝেমধ্যে বাজার সংশোধন হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু টানা উত্থান কিংবা টানা পতন কোনোটাই বাজারের জন্য ভালো নয়।’
সম্প্রতি দুর্বল কিছু কোম্পানির শেয়ারের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এসব কোম্পানির শেয়ার নিয়ে সুয়োগসন্ধানীরা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। তাই বিনিয়োগকারীদের সতর্ক থাকার বিকল্প কিছু হতে পারে না।’
একই বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ব্রেকারেজ হাউজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘বাজারে সব সময় একটি চক্র থাকে। এর সঙ্গে জড়িত থাকে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। তারা কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারের দর বাড়িয়ে তা অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে বাজার থেকে সরে পড়েন। পতনের বাজারে ফিরে এসে তারা আবারও শেয়ার কিনে কারসাজি করেন।’
অন্যদিকে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলে ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, ‘বাজারে উত্থান-পতন থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু শেয়ারের দর কমলে তা মেনে নিতে পারেন না বিনিয়োগকারীরা। ফলে দ্রুত সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এটা না করে তাদের ধৈর্য ধারণ করা উচিত।’
Add Comment