ইসমাইল আলী: ২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরে ১০০ কোটি ডলার রাষ্ট্রীয় ঋণ (এলওসি) অনুমোদন করে ভারত। পরে ২০ কোটি ডলার অনুদান হিসেবে মঞ্জুর করে দেশটি। তবে সাত বছরে এলওসির মাত্র সাড়ে ৩২ কোটি ডলার ব্যবহার করেছে বাংলাদেশ। এ সময়ে আটটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও ঝুলে আছে সাতটি। এগুলোর মেয়াদ এরই মধ্যে কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে।
গত ২৯ ও ৩০ নভেম্বর ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয় এলওসির দশম পর্যালোচনা বৈঠক। এতে এলওসির গতিহীন সাত প্রকল্প নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে ভারত। পাশাপাশি ছয় মাস অন্তর এলওসির অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা না দেওয়ার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়।
প্রকল্পগুলোর দ্রুত বাস্তবায়নে উচ্চপর্যায়ের তদারকি কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয় বৈঠকে। এ কমিটি তিন মাস পর পর প্রকল্পটির অগ্রগতি পর্যালোচনা করবে।
বৈঠকে জানানো হয়, এলওসির আওতায় আটটি প্রকল্প শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি বাস্তবায়ন করেছে রেলওয়ে, একটি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) ও একটি মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পগুলো হলোঃ ১৬৫টি ব্রড গেজ ও ৮১টি মিটার গেজ তেলবাহী ওয়াগন কেনা, ২২০টি মিটার গেজ কনটেইনারবাহী ওয়াগন কেনা, ২৬টি মিটার গেজ ইঞ্জিন কেনা, ২৯০টি দ্বিতল, ৫০টি আর্টিকুলেটেড (দুই বগির জোড়া লাগানো বাস) ও ৮৮টি একতলা এসি বাস কেনা এবং একটি ড্রেজার কেনা। এগুলোর জন্য ১৬ কোটি ২৬ লাখ ডলার ঋণ ব্যবহার করা হয়েছে।
বাকি সাতটি প্রকল্প বাস্তবায়ন চলছে ধীরগতিতে। এগুলোয় ব্যয় করা হয়েছে ১৬ কোটি ৩১ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে সাত বছরে এলওসির ৩২ কোটি ৫৭ লাখ ডলার ব্যবহার করা হয়েছে। বাকি অর্থ দ্রুত ব্যবহারে তাগিদ দেওয়া হয় বৈঠকে।
তথ্যমতে, বিএসটিআই আধুনিকায়ন ও শক্তিশালী করার জন্য ভারতীয় ঋণ সহায়তায় নেওয়া প্রকল্পের এলসির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে সাতবার। সর্বশেষ মেয়াদে প্রকল্পের কাজ করতে কিছুটা অনীহা প্রকাশ করেছে ভারতের অ্যানালিটিক্যাল টেকনোলজিস লিমিটেড। ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা থাকলেও তা নিশ্চিত নয়। এ অবস্থায় চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিলেও ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। এক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ভারতের পক্ষ থেকে চাপ দেওয়ার অনুরোধ করা হয়।
এদিকে রেলওয়ের তিন প্রকল্পের বাণিজ্যিক চুক্তিতে ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সম্মতিপ্রাপ্তিতে বিলম্ব হয়। এতে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন আটকে ছিল প্রায় এক বছর। মূলত ব্যয় বৃদ্ধির জন্য আপত্তি তোলে এক্সিম ব্যাংক। এগুলো হলোঃ খুলনা-মোংলা রেললাইন নির্মাণ, ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েল গেজ লাইন ও টঙ্গী-জয়দেবপুর ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ এবং কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশন পুনর্বাসন। প্রকল্প ব্যয় বাড়ায় অতিরিক্ত বরাদ্দ দিতে এক্সিম ব্যাংককে অনুরোধ করা হয়।
জানা গেছে, জমি অধিগ্রহণ জটিলতা ও মহিষের খামারের কারণে বিলম্বিত হচ্ছে খুলনা-মোংলা রেলপথ নির্মাণ। তবে প্রকল্পটির আওতাধীন রূপসা সেতুর কাজ শুরু হয়েছে। আর ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েল গেজ লাইন ও টঙ্গী-জয়দেবপুর ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ ভৌত কাজ শুরুই করা যায়নি। এ বছরের জানুযারিতে ভারতের সম্মতি পাওয়ার পর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আরভি অ্যাসোসিয়েশন ও আয়েশা ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড আর্কিটেক্টকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি নকশা জমা দিয়েছে। কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশন পুনর্বাসন প্রকল্পে ভারতের বালাজি রেল রোড সিস্টেম লিমিটেডকে এপ্রিলে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় ভৈরব এবং দ্বিতীয় তিতাস সেতু নির্মাণ প্রকল্পের ৭৯ শতাংশ কাজ শেষ হলেও গত অর্থবছরে ভারতের ঋণ থেকে বরাদ্দ ১০৪ কোটি টাকা ব্যয় করা সম্ভব হয়নি। কাজের অগ্রগতি থেমে আছে ভারতীয় ঠিকাদার আইআরসিওএন এফকনস জেবি এবং গানোন এফএলসিএলের কারণে। বিলম্বের কারণে প্রকল্পটির ব্যয়ও বেড়ে গেছে। দ্বিতীয় ভৈরব সেতু ও দ্বিতীয় তিতাস সেতুর পরামর্শক অংশে ভারতীয় অংশে ১৯ লাখ ৬০ হাজার ডলার ব্যয় বেড়েছে। দ্বিতীয় ভৈরব সেতু নির্মাণে ব্যয় বেড়েছে ৮১ লাখ ডলার। আর দ্বিতীয় তিতাস সেতু নির্মাণে ব্যয় বেড়েছে ২৭ লাখ ডলার। তিন খাতে এক কোটি ২৮ লাখ ডলার অতিরিক্ত প্রয়োজন হবে। বাড়তি অর্থ দ্রুত বরাদ্দ দেওয়ার জন্য ভারতকে অনুরোধ করা হয়।
এদিকে ১২০টি ব্রড গেজ কোচ কেনা ও আশুগঞ্জ-আখাউড়া সেকশনে তিনটি স্টেশন সিগনালিং আধুনিকায়ন প্রকল্পেও কোনো গতি নেই। এর মধ্যে আশুগঞ্জ-আখাউড়া সেকশনে সিগন্যালিং ব্যবস্থা আধুনিকায়নে ভারত থেকে সিগন্যালিং যন্ত্রপাতি ক্রয়ে গত এপ্রিলে এলসি খোলা হয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, এলওসির আওতায় কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে ভারতের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে। বৈঠকে এক্ষেত্রে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে ভারতের এক্সিম ব্যাংক, রেলপথ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ রেলওয়ে, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি থাকবে। তিন মাস অন্তর অন্তর প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করবে এ কমিটি। পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা দূর করতে পদক্ষেপ নেবে তারা।
উল্লেখ্য, ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ইআরডির ১০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি সই হয় ২০১০ সালের আগস্টে। ২০১২ সালে এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ থেকে ২০ কোটি ডলার অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দেয় ভারত। আর গত বছরের আগস্টে এলওসিতে অতিরিক্ত অর্থ হিসেবে আরও ছয় কোটি ২০ ডলার ঋণ অনুমোদন করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। সব মিলে প্রথম এলওসিতে ভারতের ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৬ কোটি ২০ লাখ ডলার। এর মধ্যে মাত্র ৩৮ শতাংশ ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে।