Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 11:58 am

দাম কম হলেও ডিজেলের চেয়ে ১০ টাকা বেশি হবে অকটেন!

নিজস্ব প্রতিবেদক: জ্বালানি তেলের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে মাসে মাসে নির্ধারণের কথা অনেক দিন ধরে বলে আসছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত মেনে গত বছর এটি কার্যকরের উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের কারণে তা পিছিয়ে দেয়া হয়। অবশেষে এ-সংক্রান্ত নির্দেশিকা জারি করেছে জ্বালানি বিভাগ।

স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার-সংক্রান্ত ১০টি বিবেচ্য বিষয় দিয়ে হিসাব-নিকাশ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য নির্ধারণ করা হবে। বৃহস্পতিবার রাত ১০টার পর প্রকাশ করা এ-সংক্রান্ত নির্দেশিকা অনুযায়ী চলতি মার্চ থেকেই জ্বালানির মূল্য সমন্বয় করতে হবে। নতুন সিদ্ধান্ত আসার আগ পর্যন্ত প্রতি মাসেই জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ করা হবে।

যদিও নির্দেশিকার কয়েকটি ধারা নিয়ে রয়েছে কিছুটা বিতর্ক। এর মধ্যে অন্যতম হলো অকটেনের মূল্য। ডিজেলের চেয়ে অকটেনের সরবরাহ মূল্য কম হলেও এ জ্বালানির দাম কমানো হবে না। বরং ডিজেলের চেয়ে ১০ টাকা বেশি রাখা হবে অকটেনের দাম। এজন্য অকটেনের দাম নির্ধারণের সূত্রে বিশেষ ফ্যাক্টর বিবেচনা করা হয়েছে। একইভাবে পেট্রোলের উৎপাদন ব্যয় যাই হোক তার মূল্য অকটেনের চেয়ে চার টাকা কম হবে।

এ হিসাবে ডিজেলের সরবরাহ মূল্য ১৩০ টাকা হলে অকটেনের দাম পড়বে কমপক্ষে ১৪০ টাকা। যদি অকটেনের উৎপাদন ব্যয় কমও হয় তবু দাম ১৪০ টাকার কম হবে না। আর পেট্রোলের দাম পড়বে কমপক্ষে ১৩৬ টাকা। বর্তমানে ডিজেলের চেয়ে অকটেনের দাম ২১ টাকা বেশি। আর অকটেনের চেয়ে পেট্রোলের দাম পাঁচ টাকা কম। অর্থাৎ ডিজেল বিক্রি করা হয় ১০৯ টাকায়, অকটেন ১৩০ ও পেট্রোল ১২৫ টাকায়।

যদিও বিশ্বের অনেক দেশেই ডিজেলের চেয়ে অকটেন ও পেট্রোলের দাম কম রাখা হয়। পাকিস্তানে বর্তমানে পেট্রোলের দাম প্রতি লিটার ২৭৫ দশমিক ৬২ রুপি। অথচ দেশটিতে ডিজেলের দাম প্রতি লিটার ২৮৭ দশমিক ৩৩ রুপি। একইভাবে শ্রীলঙ্কায় প্রতি লিটার পেট্রোলের দাম ৪৫৬ শ্রীলঙ্কান রুপি ও ডিজেলের দাম ৪৬৮ শ্রীলঙ্কান রুপি। এছাড়া মালয়েশিয়ায় বর্তমানে পেট্রোল ২ দশমিক ০৫ রিঙ্গিত ও ডিজেল ২ দশমিক ১৫ রিঙ্গিত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশেও পেট্রোল-অকটেনের দাম কম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তা কৃত্রিমভাবে ডিজেলের চেয়ে বেশি রাখা হবে বলে নির্দেশিকায় বলেই দেয়া হয়েছে। এটা কোনোভাবেই স্বয়ংক্রিয় জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ হতে পারে না।

এদিকে জ্বালানি তেলের মূল্যের ওপর বিপিসি ও তেল বিতরণকারী কোম্পানির পৃথক মুনাফা মার্জিন ধরা হয়েছে। এছাড়া ভ্যাট-শুল্ক তো রয়েছেই। এতে তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে অনেক বেশি পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নির্দেশিকা অনুযায়ী, স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের প্রক্রিয়া হলো: ডিজেল-কেরোসিনের স্বয়ংক্রিয় বিক্রয় মূল্য = পণ্য মূল্য+আমদানি শুল্ক, অগ্রিম আয়কর ও আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট+অপারেশনাল ব্যয়+আর্থিক, প্রশাসনিক ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়+বিপিসির মার্জিন+ভ্যাট+বিক্রয় ও বিতরণ খরচ। আর অকটেনের স্বয়ংক্রিয় বিক্রয় মূল্য = পণ্য মূল্য+আমদানি শুল্ক, অগ্রিম আয়কর ও আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট+অপারেশনাল ব্যয়+আর্থিক, প্রশাসনিক ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়+বিপিসির মার্জিন+আলফা+ভ্যাট+বিতরণ খরচ।

স্বয়ংক্রিয় মূল্য কাঠামো বলতে পূর্ববর্তী মাসের বা একটি নির্দিষ্ট সময়ের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের চলমান গড়ের ভিত্তিতে জ্বালানি তেলের আমদানি ব্যয়, সংশ্লিষ্ট সময়ের ডলারের গড় বিনিময় হার, শুল্ক-কর, বিপিসির মার্জিন ও আনুষঙ্গিক ব্যয় বিবেচনায় নিয়ে মূল্য ঠিক করা হবে।

আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য: আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য বলতে পরিশোধিত জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালে প্রকাশিত মিন অব প্ল্যাটস অ্যারাব গালফ অনুযায়ী বিপিসির আমদানি করা বিভিন্ন গ্রেডের জ্বালানি তেলের মূল্যকে বোঝাবে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে ব্যবহƒত ক্রুড অয়েলের মূল্যকে বোঝাবে।

চলমান গড় মূল্য: চলমান গড় মূল্য বলতে আমদানি করা পরিশোধিত জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের প্রতিদিনের প্লাটস-এ প্রকাশিত মূল্যের চলমান গড়কে বোঝাবে। তবে যেসব পণ্য ইস্টার্ন রিফাইনারিতে (ইআরএল) উৎপাদিত হয়, সেসব ক্ষেত্রে আনুপাতিক হারে ইআরএলে উৎপাদিত ও আমদানিকৃত পরিশোধিত জ্বালানি তেলের গড় মূল্যের ভিত্তিতে নিরূপিত মূল্যকে ধরা হবে।

প্রিমিয়াম: পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির মূল্য ছাড়া অন্যান্য ব্যয়। যেমন: জাহাজ ভাড়া, ইন্স্যুরেন্স ও সংশ্লিষ্ট সরবরাহকারীর মার্জিনের সমন্বিত ব্যয়কে প্রিমিয়াম ধরা হবে।

অপারেশনাল ব্যয়: আমদানি করা জ্বালানি তেল জাহাজযোগে লোড পোর্ট থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আগমন, খালাস, মজুত ও সরবরাহের লক্ষ্যে সৃষ্ট ব্যয় অর্থাৎ হ্যান্ডলিং কমিশন, রিভার ডিউস, সার্ভে ফি, এলসি কমিশন, ওশান লস/ট্রানজিট লস, ক্রুড অয়েলের ক্ষেত্রে প্রসেসিং খরচ ইত্যাদি ব্যয়ের সমষ্টিকে অপারেশনাল ব্যয় বোঝাবে।

আর্থিক, প্রশাসনিক ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়: জ্বালানি তেল আমদানিতে ব্যয়িত অর্থের ইন্টারেস্ট, প্রশাসনিক ব্যয় ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন/রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের সমষ্টিকে বোঝাবে।

ব্যবসায়ী পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর: জ্বালানি তেলের খুচরা বিক্রয় মূল্যের ওপর ব্যবসায়ী পর্যায়ে পরিশোধিত মূসককে বোঝাবে।

ফ্রেইটপুল: ফ্রেইটপুল বলতে চট্টগ্রাম প্রধান স্থাপনা থেকে সারাদেশে ডিপোগুলোতে জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য ব্যবহƒত পরিবহন ভাড়ার পুলকে বোঝাবে।

ডিলার/এজেন্টস কমিশন ও পরিবহন: জ্বালানি তেল বিপণনের ক্ষেত্রে পেট্রোল পাম্প ডিলার/এজেন্টকে খুচরা পর্যায়ে জ্বালানি তেল বিক্রির জন্য লিটারপ্রতি যে কমিশন দেয়া হবে।

উন্নয়ন তহবিল: জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থে জ্বালানি তেলের অবকাঠামোগত উন্নয়নের লক্ষ্যে বাস্তবায়িত প্রকল্পের ব্যয়িত অর্থ রিকভারি এবং বাস্তবায়িতব্য প্রকল্পের আর্থিক সংস্থানের জন্য সংগৃহীত তহবিল।

কোম্পানি মার্জিন: সারাদেশে সরকার-নির্ধারিত মূল্যে জ্বালানি তেল বিক্রির জন্য তেল বিপণন কোম্পানিগুলোকে লিটারপ্রতি প্রদত্ত মার্জিন।

নির্ধারিত ১০টি বিষয়ের বাইরেও তেলের দাম নির্ধারণে কয়েকটি সাধারণ শর্ত রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেÑক. জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী মাসের বা একটি নির্দিষ্ট সময়ের গড় মূল্য বিবেচনায় নিতে হবে। যেমন, এপ্রিল মাসের ১ তারিখ থেকে জ্বালানি তেলের মূল্য কার্যকর করার ক্ষেত্রে ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ থেকে মার্চ মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত অর্থাৎ পূর্ববর্তী এক মাসের সুবিধাজনক সময় বিবেচনায় নিতে হবে। ক্রুড অয়েলের ক্ষেত্রে উল্লিখিত সময়ের পার্সেলের মূল্য বা ওই সময়ের একাধিক পার্সেলের গড় মূল্য বিবেচিত হবে, তবে ওই সময়ের মধ্যে ক্রুড অয়েলের কোনো পার্সেল না এলে তৎপূর্ববর্তী সময়ের পার্সেল বিবেচনা করা যাবে।

খ. ফর্মুলায় পরিশোধিত জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম হিসেবে প্রতি ছয় মাসের জন্য প্রকাশিত জিটুজি ও টেন্ডারের প্রিমিয়ামের গড় বিবেচনায় নিতে হবে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের (ক্রুড অয়েল) জন্য বিপিসি কর্তৃক আমদানিকৃত ক্রুড অয়েলের জাহাজ ভাড়া, লাইটারেজ, ইন্স্যুরেন্স ইত্যাদি ব্যয় বিবেচনায় নিতে হবে।

গ. বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যের অস্বাভাবিক হ্রাস/বৃদ্ধিজনিত কারণে জনদুর্ভোগ কমাতে ভোক্তা পর্যায়ে জ্বালানি তেলের মূল্য সহনীয় ও গ্রহণযোগ্য মাত্রায় নির্ধারণে সরকার বিপণন কোম্পানি/বিপিসির মার্জিন সমন্বয় করতে পারবে।

নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, বাস্তবতার নিরিখে দেশে ব্যবহƒত অকটেন ও পেট্রোল ব্যক্তিগত যানবাহনে অধিক পরিমাণে ব্যবহƒত হয় বিধায় এর মূল্য বিলাস দ্রব্য (লাক্সারি আইটেম) হিসেবে সব সময় ডিজেলের চেয়ে বেশি রাখা হয়। বর্তমানে ডিজেল ও অকটেনের খুচরা বিক্রয় মূল্য পার্থক্য লিটারপ্রতি ২১ টাকা। ফর্মুলা অনুযায়ী অকটেনের মূল্য নির্ধারণকালে ডিজেলের সঙ্গে পার্থক্য লিটারপ্রতি ন্যূনতম ১০ টাকা যেন থাকে সেজন্য প্রাইসিং ফর্মুলায় ‘আলফা’ ফ্যাক্টর বিবেচিত হবে।