Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 9:16 pm

দাম বৃদ্ধির পরও বিদ্যুতে ভর্তুকি লাগবে ৩৬০০ কোটি টাকা

ইসমাইল আলী: ১০ বছরের ব্যবধানে নবমবার বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। বৃহস্পতিবার এ ঘোষণা দেওয়া হয়, যা আগামীকাল থেকে কার্যকর হবে। এরই মধ্যে পাইকারি (বাল্ক) বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে প্রতি ইউনিটে ৪০ পয়সা বা আট দশমিক চার শতাংশ।

এর পরও বাল্ক খাতে প্রতি ইউনিটে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ঘাটতি রয়ে গেছে ৪৭ পয়সা। এ ঘাটতি পোষাতে সরকারকে বিদ্যুৎ খাতে চলতি বছর তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে।

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) জারিকৃত মূল্যবৃদ্ধির আদেশে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ভর্তুকির চাপ কমাতে বাল্ক খাতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। তবে পিডিবির যতটা ঘাটতি ছিল, তা পূরণ করতে হলে ১৮ দশমিক ২৪ শতাংশ তথা ইউনিটপ্রতি ৮৭ পয়সা দাম বাড়ানো দরকার। এর মধ্যে আট দশমিক চার শতাংশ বা ৪০ পয়সা দাম বাড়ানো হচ্ছে। বাকিটা অর্থাৎ ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ বা ৪৭ পয়সা ভর্তুকি হিসেবে দেবে সরকার।

তথ্যমতে, গত  অর্থবছর (২০১৮-১৯) আট হাজার ১৪১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা লোকসান গুনেছে পিডিবি। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছর সংস্থাটির লোকসান ছিল রেকর্ড ৯ হাজার ৩১০ কোটি ১৫ লাখ টাকা। উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি করায় এ লোকসান দিতে হয়েছে পিডিবিকে। আর লোকসানের ঘাটতি মেটাতে গত দুই অর্থবছর ধরে সরাসরি ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছর ভর্তুকি দেওয়া হয় ৯৫৬ কোটি ২০ লাখ টাকা। আর গত অর্থবছর রেকর্ড ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে পিডিবিকে। এর পরিমাণ ছিল সাত হাজার ৯৬৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।

লোকসানের বোঝা কমাতে বাল্ক (পাইকারি) মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করে পিডিবি। আর বাল্ক বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির অনুপাতে গ্রাহক পর্যায়ে (খুচরা) বিদ্যুতের দামও বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গণশুনানি করে বিইআরসি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়।

বাল্ক মূল্য বৃদ্ধির আদেশে বলা হয়েছে, চলতি বছর পিডিবি বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে দুই হাজার ৩৬২ কোটি ২০ লাখ ইউনিট। আর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কেনা হবে চার হাজার ৭৩৭ কোটি ৬০ লাখ ইউনিট। আর ভারত থেকে আমদানি করবে ৭৮৬ কোটি ৭০ লাখ ইউনিট। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ কেনা ও আমদানির পরিমাণ দাঁড়াবে সাত হাজার ৮৮৬ কোটি ৫০ লাখ ইউনিট।

গ্রিডে ব্যবহার ও সঞ্চালন লোকসান বাদ দিয়ে বিতরণকারী কোম্পানিগুলোর কাছে নিট বিদ্যুৎ বিক্রি করা হবে সাত হাজার ৬৭৪ কোটি ইউনিট। এর মধ্যে পিডিবি নিজে গ্রাহক পর্যায়ে বিক্রি করবে এক হাজার ৩৪৬ কোটি ৯০ লাখ ইউনিট। আর পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড তিন হাজার ৮২৮ কোটি ৮০ লাখ, ডিপিডিসি এক হাজার ৪১ কোটি ৩০ লাখ, ডেসকো ৬১৭ কোটি ৮০ লাখ, ওজোপাডিকো ৩৯৫ কোটি ৭০ লাখ ও নেসকো ৪৪৩ কোটি ৫০ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ নেবে পিডিবি থেকে।

এদিকে পিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনে সম্ভাব্য ব্যয় হবে সাত হাজার ২৯৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আর সরকারি-বেসরকারি খাত থেকে কেনা ও ভারত থেকে আমদানি বাবদ ব্যয় হবে ৩৪ হাজার ৮৩৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে পিডিবির ব্যয় দাঁড়াবে ৪২ হাজার ১৩৩ কোটি ১০ লাখ টাকা। এর সঙ্গে বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন তহবিলে যাবে এক হাজার ১৫১ কোটি ১০ লাখ টাকা। অর্থাৎ পিডিবির নিট রাজস্ব চাহিদা দাঁড়াবে ৪৩ হাজার ২৮৪ কোটি ২০ লাখ টাকা।

এর ভিত্তিতে প্রতি ইউনিট বাল্ক বিদ্যুতের দাম পড়বে পাঁচ টাকা ৬৪ পয়সা। কিন্তু পিডিবির বর্তমান বাল্ক বিদ্যুতের দাম রয়েছে চার টাকা ৭৭ পয়সা। এতে ঘাটতি রয়েছে পাঁচ হাজার ৫২৮ কোটি ১২ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে ঘাটতি রয়ে গেছে ৮৭ পয়সা। এ ঘাটতি পূরণে ১৮ দশমিক ২৪ শতাংশ দাম বাড়ানো দরকার।

বিইআরসি বাল্ক মূল্য বৃদ্ধির আদেশে জানায়, চলতি ২০২০ সালে পিডিবিকে সরকার তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা, তথা প্রতি ইউনিটে ৪৭ পয়সা ভর্তুকি প্রদান করবে বিবেচনায় দাম ৪০ পয়সা বাড়ানো হলো। এতে প্রতি ইউনিট বাল্ক বিদ্যুতের দাম ভারিত গড়ে দাঁড়াবে পাঁচ টাকা ১৭ পয়সা।

যদিও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা দেখছেন না ভোক্তা সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতে ‘অযৌক্তিক’ ব্যয় না কমিয়ে সরকার জনগণের ব্যয়ভার বাড়িয়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে আগের ধারাবাহিকতায় গতানুগতিক ঐকিক নিয়মে বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারিত হয়েছে। কোনো পর্যায়ের ভোক্তার জন্যই মূল্য বৃদ্ধির যৌক্তিকতা এ আদেশে প্রতিফলিত হয়নি।

তিনি বলেন, ‘গণশুনানিতে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলাম। বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয় যেভাবে অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি দেখানো হয়েছে, সেসব প্রতিবিধানের কথা আমরা বলেছিলাম। ৯ হাজার কোটি টাকার ওপরে অযৌক্তিক ব্যয় যদি সমন্বয় করা হতো, তাহলে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির দরকার হতো না। এছাড়া কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রয়োজন না থাকলেও সেগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ অর্থ দেওয়া হচ্ছে। এ কারণেই পিডিবির ঘাটতি বাড়ছে। এ ধরনের কাজের দায়ভার চাপানো হচ্ছে জনগণের ওপর।’

শামসুল আলম আরও বলেন, ‘সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিপিসির দেওয়া তেলে চলতে পারলেও বেসরকারি কেন্দ্রগুলো নিজেরা পৃথকভাবে তেল আমদানি করে। ফলে সেখানে অনেক বেশি বাড়তি খরচ হয়। এসব খরচ বিদ্যুতের উৎপাদনের খরচ বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া নিজেরা তেল আমদানির নামে বহু রকমের দুর্নীতি হয়। বিপিসির তেলের মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে সেটার সমাধান করা উচিত। বেসরকারিভাবে তেল আমদানির এই ফাঁদ দুর্নীতির একটি উৎস। এই উৎস বন্ধ করতে হবে। স্বচ্ছতার সঙ্গে ঘাটতির প্রকৃত পরিমাণ হিসাব না করে, সেই হিসাব বিবেচনায় নিয়ে যদি দাম বাড়ানো হয়, সেটা জনগণের সঙ্গে অন্যায় করা হবে।’

উল্লেখ্য, বাল্ক মূল্যহারের পাশাপাশি গ্রাহক পর্যায়ে (খুচরা) প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ৩৬ পয়সা বা পাঁচ দশমিক তিন শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে প্রতি ইউনিটের দাম ছয় টাকা ৭৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে সাত টাকা ১৩ পয়সা। আর বিদ্যুৎ সঞ্চালন মূল্যহার বা হুইলিং চার্জও পাঁচ দশমিক তিন শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।