Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 2:39 pm

দায়বদ্ধতা কি শুধু সরকারের?

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। ২০০৮ সালে গৃহীত ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রত্যয়টি সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচ্য বিষয়; যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে একুশ শতকে বাংলাদেশকে একটি তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা এবং ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের বছরে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর করা। এ লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে দারিদ্র্যবিমোচনসহ কৃষি-স্বাস্থ্য-শিক্ষা উন্নয়ন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধার্থে অপটিক্যাল ফাইবার স্থাপন, ই-কমার্স ও ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশ, মেট্রোরেল স্থাপন, পদ্মা সেতু তৈরি, সরকারি তথ্য ও সেবা প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে কয়েকটি সরকারি হটলাইন নম্বর (৩৩৩-সরকারি তথ্য ও সেবা, ৯৯৯ জরুরি সেবা পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স, ১০৯ শিশু ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, ১০৬ দুদক) চালু করাসহ ইত্যাদি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরে ১৪৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ২০২১ সাল পর্যন্ত আবিষ্কৃত ২৮টি প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে, যা দেশের জন্য একটি অমূল্য সম্পদ।

দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের উদ্দেশ্যেই মূলত এসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং গৃহীত পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকারের নিরলস প্রচেষ্টা চলমান আছে। কিন্তু সরকারের একাধিক কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ সত্ত্বেও উদাসীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে জনসাধারণের মধ্যে।

বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে একটি বৃহৎ বাধা হলো দেশের সাধারণ জনগণের দায়িত্বের প্রতি বিমুখতা ও নৈতিকতার অভাব। জনগণের মধ্যে দেশীয় সম্পদ অপচয়ের একটি প্রবণতাও দেখা যায়। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা, বাসাবাড়িতে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস অপচয় অহরহ একটি ব্যাপার। দেশে যতই গ্যাস বা বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকুক না কেন, সুপেয় পানির ব্যবস্থা থাকুক না কেন, প্রাকৃতিক সম্পদ ভাণ্ডার যেকোনো সময় শূন্য হয়ে যেতে পারে। তাই এসব সম্পদের অবাধ ব্যবহার ও অপচয় থেকে যথাসম্ভব রোধ করা না গেলে সময়ের পরিক্রমায় আমাদের বিপদের সম্মুখীন হতে হবে।

তাছাড়া বর্তমান সময়ে আইন অমান্য করা এক ধরনের ফ্যাশনে পরিণত হয়ে গেছে। ট্রাফিক রুলস অমান্য করে গাড়ি চালানো, হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেল চালানো আজকাল এক নতুন ফ্যাশন। সরকার জনজীবন সুরক্ষার প্রতি সচেতন থেকে হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেল চালালে জরিমানা নির্ধারণ করেছে; ফলে জীবন নয় বরং টাকার মায়ায় মানুষ হেলমেট পরিধান করছে। নিজের অজান্তেই যেন এক লজ্জাহীন জাতিতে আমরা রূপান্তর হয়ে গিয়েছি, যাদের অধিকাংশের কাছে জীবন অপেক্ষা টাকা অধিক মূল্যবান। আবার সরকার ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগ করেছে যানবাহনের কর্মকাণ্ড তদারকি করতে কিন্তু তাদের অধিকাংশই নৈতিকতার বিসর্জন দিয়ে টাকার লোভে আরোপিত দায়িত্বের ঊর্ধ্বে গিয়ে কিছু কাজ করছে এবং তাদের এই কাজ করতে উৎসাহিত করছে সাধারণ মানুষ। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালিয়ে, ট্রাফিক রুলস অমান্য করে ট্রাফিক পুলিশকে টাকার বিনিময়ে নীরব করে রাখার মতো কর্মকাণ্ড সাধারণ জনগণই করে থাকে, কিন্তু এর ফলাফল যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাধারণ জনগণকেই ভোগ করতে হচ্ছে, তার উপলব্ধি করে গুটিকয়েক জন। সরকার ৯৯৯ সেবা চালু করেছে জনসাধারণকে জরুরি সেবা দিতে। অনেকে প্রয়োজনের সময় এই সেবার আওতায় এসেছেন। পক্ষান্তরে যথাসময়ে এই সেবা পাওয়া যাচ্ছে না বলেও অনেকের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু এই হটলাইন নাম্বারে কল দিয়ে রুচিবিরুদ্ধ কথা বলে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করার মতো কাজ কিছু নৈতিকতা বিবর্জিত সাধারণ মানুষের মাধ্যমেই হচ্ছে।

অনেক রাস্তার পাশে প্রশাসনিক উদ্যোগে পকেট ডাস্টবিন নির্মাণ করা হয়েছে অথচ কয়জন মানুষ সেই ডাস্টবিনে আবর্জনা ফেলে? প্রশাসনে যাদের কর্মী হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে, তারাও সাধারণ জনগণের মধ্যেই পরে অথচ কয়টা রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট যথাসময়ে জ্বালানো হয়? কয়টা এলাকায় মশার ওষুধ প্রতিদিন দেয়া হয়? কয়টা এলাকার জলপ্রণালি ঠিকভাবে পরিষ্কার করা হয়? এসব কিছু প্রতিনিয়ত স্বচক্ষে তদারকি করার দায়িত্ব সরকারের না বরং দায়িত্বরত নেতা, কর্মকর্তা পাশাপাশি সাধারণ জনগণের। সাধারণ মানুষের এই দায়িত্বহীনতার কথা তুলে ধরতে থাকলে বাকসীমা নিরবচ্ছিন্নভাবে চলমান রাখা যাবে।

একটি দেশকে উন্নয়নের পথে ধাবমান করতে সরকার ও সাধারণ জনগণ উভয়ের সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি। একপক্ষীয় প্রচেষ্টা সর্বদা ফলপ্রসূ হয় না। একটি দেশের জনগণ যদি জনসম্পদে পরিণত হতে না পারে, তবে সে দেশ অগ্রগতি অপেক্ষা অধঃগতির দিকে অধিক ধাবিত হয়। দেশ ও জনগণের কল্যাণে সরকার গৃহীত কর্মসূচিতে শূন্যতা থাকলেও জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা আনয়ন করা জরুরি। সরকারের ওপর আঙুল তোলার আগে আমাদের নিজেদের দিকে, নিজেদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের দিকে একবার ভালো করে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। তবেই আমরা বুঝতে পারব যে, অপ্রতুলতা শুধু একদিকে নয়। একটি দেশের উন্নয়নে কার্যকরী সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি জনসচেতনতা একান্ত কাম্য।

আতিয়া ফাইরুজ ঐশী খান

শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়