মো. হাবিবুর রহমান: রাবেয়া ২০২০ সালে সরকারি ব্যাংক থেকে এক লাখ টাকা কৃষি ঋণ নিয়ে বাড়ির পাশে একটি ছোট্ট খামার গড়ে তোলেন। বর্তমানে তার খামারে ৫টি গাভী ও ১০টি ছাগল, ২০টি মুরগি রয়েছে। রাবেয়ার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করছে। লেখাপড়ার ফাঁকে তারা মায়ের কাজে সহযোগিতা করে। রাবেয়ার স্বামী প্রতিদিন সকালে ভ্যানে করে গাভীর দুধ বাঘাবাড়ি মিল্ক ভিটায় পৌঁছে দেন। এখন রাবেয়ার সংসারে আর অভাব নেই। রাবেয়ার এ কাহিনি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। আমাদের দেশে উন্নয়নের নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে যাচ্ছে রাবেয়ার মতো গ্রামীণ নারীরা।
রাবেয়ার স্বামী সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার বনগ্রামের বাসিন্দা রশিদ মিয়া একসময় ভ্যান চালিয়ে কোনোমতে, সংসার চালাতেন। চার ছেলেমেয়েসহ মোট ছয়জনের সংসারে অভাব তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী ছিল। রশিদ মিয়াকে অসুস্থতার কারণে প্রায় দিনই ভ্যান চালানো থেকে দুই-তিনদিন বিশ্রাম নিতে হতো। সংসারে অভাবের জন্য স্ত্রী রাবেয়ার সঙ্গে নিজেও ঝিয়ের কাজ নিয়েছিলেন অন্যের বাড়িতে। তারপরও সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকত।
সে সময়ই একদিন বেসরকারি সংস্থার এক কর্মীর সঙ্গে রাবেয়ার পরিচয় হয়। তার কাছে সংসারের অভাবের কথা খুলে বললে বেসরকারি সংস্থার ওই কর্মী সমিতি থেকে কিস্তিতে ঋণ নিয়ে ছাগল, হাঁস-মুরগি পালনের পরামর্শ দেন রাবেয়াকে এবং তাকে ঋণ পেতে সাহায্য করেন। রাবেয়া প্রথমে দশ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তিনটি ছাগল ও চারটি মুরগি কিনে বাড়ির আঙিনায় পালন শুরু করেন। এক বছরের মধ্যে দুটি ছাগল বাচ্চা দেয়। ছাগলের বাচ্চা ও মুরগির ডিম বিক্রি করে রাবেয়া ঋণের টাকা পরিশোধ করেন। লেনদেন ভালো হওয়ায় ওই সমিতি থেকে আবার রাবেয়া ৩০ হাজার টাকা ঋণ নেন। এ ঋণের টাকা দিয়ে তিনি একটি গাভী কিনেন। গাভীটি প্রতিদিন তিন লিটার করে দুধ দিত। গাভীর দুধ ও ডিম বিক্রি করে রাবেয়ার সংসারে উন্নতি হতে থাকে।
উন্নয়নশীল দেশের জন্য দারিদ্র্য মোকাবিলা করা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ এ চ্যালেঞ্জ দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করে যাচ্ছে। দারিদ্র্যের হার প্রশংসনীয়ভাবে অনেক কমে এসেছে। ইতোমধ্যে সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে চলেছে। এসব পরিকল্পনার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং দারিদ্র্যবিমোচন। সরকার বাস্তবায়িত উন্নয়ন কার্যক্রমের ফলে দারিদ্র্য যেমন হ্রাস পেয়েছে, তেমনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতে উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ যে সাফল্য অর্জন করেছে, তা দেশ ও বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে।
আমাদের দেশের নারীদের এক বিশাল অংশ আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত। দিন দিন তা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ করে কৃষিপণ্য উৎপাদন, গাভী পালন, মৎস চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, সবজি চাষ, মৃৎশিল্প, বসতবাড়ির আশপাশে বৃক্ষরোপণ এবং বাঁশ ও বেতভিত্তিক শিল্পপণ্য ইত্যাদি কাজের সঙ্গে সরকারের উৎসাহ এবং প্রণোদনার আওতায় নারীরা সরাসরি জড়িত। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে কর্মরত শ্রমিকের প্রায় ৩৪ শতাংশই নারী। শহরকেন্দ্রিক শ্রমনির্ভর শিল্পে, বিশেষত পোশাক শিল্পের আশি শতাংশ কাজ নারীরাই করে থাকে। কাপড় সেলাই, নকশা, বাটিক, বুটিক ও এমব্রয়ডারি ইত্যাদি উপার্জনমূলক কাজের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী জড়িত। এছাড়া নারীরা যুক্ত আছেন বিপণিকেন্দ্র, অভ্যর্থনা ডেক্স, বিজ্ঞাপনী সংস্থা, শিক্ষকতা, শিল্পকলা, গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারের প্রশাসনিক ও নীতিনির্ধারণী মহলের বিভিন্ন পর্যায়ে। কাজেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ যে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
দেশে দারিদ্র্যবিমোচনে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে বাড়তি খাদ্য উৎপাদন ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গ্রামীণ অর্থনীতিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। অর্থনৈতিক উন্নতির কেন্দ্রে রাখা হয় গ্রামীণ অর্থনীতিকে। বিগত ৫০ বছরে গ্রামীণ অর্থনীতিকে সব সময়ই কমবেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ কারণেই দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত ও সামাজিকভাবে প্রান্তিক অবস্থানে, বিশেষ করে হাওর ও চরাঞ্চলের নারীদের উৎপাদনশীল কাজে এবং অর্থনৈতিক মূলধারায় সম্পৃক্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এর ফলে নারীরা অর্থনৈতিক সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আয়বর্ধক কাজে উৎসাহী হচ্ছেন। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ ও সম্পদের নারীর সমান অধিকারকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। সব শ্রেণির, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা হচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১ লাখ ৭ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। …এর আগে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা বলয় খাতে বরাদ্দ ছিল ১৩ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ৭ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। সাধারণ মানুষ যাতে সহজেই এ সুবিধা ভোগ করতে পারে, সে জন্য সরকারি বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে এবারও। মাত্র দশ টাকার মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র কৃষক ব্যাংক হিসাব খুলতে পারছেন এখন। সরকারি ব্যাংক থেকে আর্থিক ঋণ সহায়তার মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত নারীরা এখন নিজেরাই উদ্যোক্তা হয়ে উঠছেন। এসবই দারিদ্র্যবিমোচনে সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত সমাজ গড়তে এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে নারীর ক্ষমতায়নের কোনো বিকল্প নেই। মৌলিক ও মানবিক চাহিদাগুলো পূরণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের নারীরা এখনও কিছু কিছু ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। সাংবিধানিকভাবে নারীর অধিকার ও নারী উন্নয়নের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও কিছু প্রতিকূলতা এবং নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই বাংলাদেশের নারীদের প্রাপ্য অধিকার অর্জনে এখনও খানিকটা পথ পাড়ি দিতে হবে, যদিও সরকার নারীদের চলার এ পথকে সুগম করতে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
দারিদ্র্য মোকাবিলায় নারীশিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার সঙ্গে জাতীয় উন্নয়নের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে নারীশিক্ষার ভূমিকা অনেক। একজন শিক্ষিত নারী শ্রমিক আর একজন অশিক্ষিত নারী শ্রমিকের মধ্যে পারিশ্রমিকের যেমন পার্থক্য রয়েছে, তেমনি কাজের গুণগত মানেও তফাত রয়েছে। তাই বেশি অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে নারীদের শিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। এ বাস্তবতা অনুধাবন করে সরকার কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিচ্ছে এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীদের দক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে।
শিক্ষা সামাজিক কল্যাণ বয়ে আনে। একজন নারীকে লেখাপড়া শেখানোর অর্থই হচ্ছে তার পুরো পরিবারকে শিক্ষিত করা। একজন নারীকে শিক্ষিত করার অর্থ তাকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা। তাই দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে নারীর এগিয়ে আসা এবং সম্মিলিত অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
দেশের উন্নতির জন্য রাবেয়াদের মতো নারীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। ইচ্ছা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে নারীরা আর পিছিয়ে থাকবে না। মনে রাখতে হবে দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে দারিদ্র্য মোকাবিলা সম্ভব নয়। সরকার গৃহীত উন্নয়নমূলক কর্মসূচিতে নারীরা যাতে সরাসরি যুক্ত হতে পারে, সে সম্পর্কে তাদের সচেতন করতে হবে, যদিও গ্রামীণ নারীদের উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে সরকার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে নারী সমাজকে স্বাবলম্বী করার ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি পুরুষদেরও এগিয়ে আসতে হবে। শুধু তাহলেই নারী সমাজ ও দেশের উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমান তালে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
-পিআইডি নিবন্ধ