ইমরান হোসাইন ইমন: দারিদ্র্য শব্দ শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভাসতে থাকে, সমাজের অর্ধাহারে-অনাহারে বেঁচে থাকা সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলোর ছবি। ২০২০ সালের বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে এখনো ৭০ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছেন। সারাবিশ্বে হতদরিদ্রের সংখ্যার দিক থেকে প্রথম স্থানে আছে ভারত, আর ষষ্ঠ স্থানে আছে বাংলাদেশ। ভারতে এখনো হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় ২৮ কোটি ৪৪ লাখ এবং বাংলাদেশে ২ কোটি ২৯ লাখ।
প্রতিদিন যেসব ব্যক্তির আয় ১ ডলার ৯০ সেন্টের কম, তাদের হতদরিদ্র হিসেবে আখ্যায়িত করছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কভিড-১৯ এবং জলবায় পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের অন্তত ৫০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য ঝুঁকিতে বসবাস করছেন। আর বাংলাদেশের এই দারিদ্র্য বৃদ্ধির আশঙ্কা থেকে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে অতিদরিদ্র দূরীকরণেও সংশয় প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক।
টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন বৈষম্যহীন সুষম অর্থনৈতিক সমাজ কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা। ধনী-দরিদ্রের মধ্যে আয়বৈষম্য হ্রাস করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মাঝে পৌঁছানোর মাধ্যমেই দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের সূচনা হয়। বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় হুমকি হলো আয়বৈষম্য। পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ ব্যক্তিদের আয় বিশ্বের মোট আয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ। আর গরিব ১০ শতাংশের আয় মাত্র ২ থেকে ৭ শতাংশ।
এসডিজি-১০ এর নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে অন্যতম হলো সমাজের ধনী-গরিব, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মাঝে আয়বৈষম্য হ্রাস করে সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। সেই সঙ্গে আয়স্তরের সর্বনি¤েœ থাকা ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করা। এসডিজি-১০, তাদের এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাংলাদেশেও অসমতা হ্রাস এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে সুনির্দিষ্ট কিছু কার্যক্রম চালু রেখেছে।
এসডিজিতে বৈশ্বিক ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। সহগ্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০১৫ সালের শেষ নাগাদ মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। কিন্তু এখন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা সহস াব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে প্রতিস্থাপন করছে। এসডিজির মেয়াদকাল ২০১৬ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত। এসডিজিতে ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা ও ১৬৯টির সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এসডিজির প্রথম লক্ষ্যমাত্রা হলো দারিদ্র্য বিলোপ। ২০৩০ সালের মধ্যে যেসব মানুষের আয় ১ ডলার ২৫ সেন্টের কম তাদের চরম দারিদ্র্যের অবসান ঘটানো। এই সময়ের মধ্যে সব মানুষ, বিশেষ করে অরক্ষিত অবহেলিত দারিদ্র্য ও শিশুদের জন্য বিশেষ অগ্রাধিকারসহ নিরাপদ স্বাস্থ্যসম্মত এবং পুষ্টিকর ও পর্যাপ্ত খাদ্য নিশ্চিত করা। এসডিজির দশম লক্ষ্যমাত্রা অসমতা হ্রাসকরণ। ২০৩০ সালের মধ্যে আয়ের দিক থেকে সর্বনিন্ম অবস্থানে থাকা ৪০ শতাংশ জনসংখ্যা বৃদ্ধি করা এবং অসমতা হ্রাসকরণে বিশেষ নীতিমালা প্রদান করা।
তাই বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন ও অসমতা দূরীকরণে সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি, যা এদেশের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দরিদ্রতার দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে এবং সামাজিক অসমতা হ্রাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বৈষম্য রোধে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। ফলে অশিক্ষিত মানুষকেও মানবসম্পদে রূপান্তরিত করা সম্ভব হবে। সমাজের অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে কারিগরি শিক্ষার প্রসারের ফলে তারা নিজেরাই নিজদের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। এক্ষেত্রে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেয়া অত্যন্ত জরুরি এবং সময়োপযোগী একটি সিদ্ধান্ত হবে। তাদের কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট সম্বন্ধে ন্যূনতম ধারণা থাকলেও ফ্রিলান্সিংকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে স্বাবলম্বী হতে পারবে।
কৃষকদের মাঝে উচ্চ ফলনশীল ফসলের বীজ, জলবায়ু পরিবর্তন-সহিষ্ণু বীজ ও সার প্রদান করতে হবে। ফলে তাদের উৎপাদন ও মজুরি বৃদ্ধি পাবে এবং বেকার শ্রমিকদের শহরকেন্দ্রিক কর্মসংস্থান অনুসন্ধানের প্রবণতা অনেকাংশে কমবে। অন্যদিকে, দারিদ্র্য জনগোষ্ঠী ও দরিদ্রতার হাত থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবে এবং বাংলাদেশ খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
যেহেতু গ্রামাঞ্চলের সিংহভাগ মানুষই দরিদ্র। তাই গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে ও অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করা সম্ভব। গ্রামের রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কালভার্ট, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যসেবা, পানির লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণ এবং সেচব্যবস্থায় সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করতে হবে। গ্রাম ও শহরের মাঝে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। গ্রামের কৃষকরা কঠোর পরিশ্রমের সঙ্গে অনেক টাকা-পয়সা ব্যয় করে ফসল উৎপাদন করলেও নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করেন। বর্ষাকালে গ্রামের কাঁচা রাস্তাগুলোতে কাদার কারণে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় হেঁটে যাওয়া অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সেখানে কৃষিপণ্য বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করা প্রায় অসম্ভব। ফলে কৃষকরা স্থানীয় পাইকারি বিক্রেতার কাছে নামমাত্র মূল্যে ফসল বিক্রি করেন। এভাবে স্থানীয় পর্যায়ের পাইকারি বিক্রেতা থেকে শুরু করে সর্বশেষ খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত সবাই লাভবান হয়। অনেক সময় ব্যবসায়ীরা কৃষকদের কাছ থেকে ক্রয়কৃত কৃষিপণ্যেগুলো দ্বিগুণ মূল্যেও বাজারে বিক্রি করেন। এতে কৃষকরা ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন। কিন্তু মাঝখানে লাভবান হন মধ্যস্বত্বভোগীরা। তাই পরিবহন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে হবে। তাই গ্রাম-শহরের মাঝে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এতে কৃষকরা উৎপাদিত কৃষিপণ্যের নায্যমূল্য পাবে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব হবে।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ১ কোটি ১৭ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ সরকার। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারগুলো নামমাত্র সুদে ঋণ নিয়ে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন কিংবা নির্দিষ্ট ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমেও স্বাবলম্বী হতে পারবে। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মানোন্নয়নের জন্য তাদের নগদ অর্থ প্রদান অথবা সুদহীন ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ও সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব।
সমাজের নিন্মশ্রেণির মানুষগুলোর মাঝে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তারা বিভিন্ন সময় সমাজের প্রভাবশালীদের দ্বারা নির্যাতিত হয়। কিন্তু তাদের ক্ষমতা আর অর্থ না থাকা সত্ত্বেও কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না। ভূমিদস্যু, দখলদার, ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, প্রভাবশালীদের আধিপত্য বিস্তারের হাত থেকে সমাজের নিন্মশ্রেণির এই মানুষগুলোকে সুরক্ষা প্রদান করতে হবে। ফলে সমাজে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে এবং ধনী-দারিদ্র্যের মধ্যে বৈষম্য অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
বাল্যবিয়ে রোধে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমেই বাল্যবিয়ে হ্রাস করা সম্ভব। কভিডকালে কুড়িগ্রাম জেলায় বাল্যবিয়ে প্রকোপ বেড়েছিল। এখনও এই জেলাটি একটি বাল্যবিয়েপ্রবণ জেলা। তাই বাল্যবিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।
স্বাস্থ্যসেবা এবং নারীশিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। সমাজের নি¤œশ্রেণির মানুষগুলো দূর থেকে শিক্ষার আলো দেখেছে। কিন্তু তারা সেই আলোয় নিজেকে আলোকিত করতে পারেনি। অন্যদিকে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। মা-শিশু, কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য প্রদান করতে হবে। এই হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারীশিক্ষার হার বৃদ্ধি করতে হবে। একজন শিক্ষিত মা পারেন একটা শিক্ষিত জাতি গঠন করতে। তাই পরিকল্পিত সমাজ ও জাতি গঠনে শিক্ষার বিকল্প নেই।
করারোপ পদ্ধতির মাধ্যমেও দারিদ্র্য বিমোচন করা যেতে পারে। সমাজে কর ফাঁকি দেয়ার মাধ্যমে ধনীরা দিন দিন আরও ধনীতে পরিণত হচ্ছে, অন্যদিকে গরিবরা আরও গরিবে পরিণত হচ্ছে। তাই করারোপ পদ্ধতি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়