‘দালাল ছাড়াই’ করা যাচ্ছে বন্ড লাইসেন্স

নিজস্ব প্রতিবেদক: অনলাইনে লাইসেন্সের আবেদন করা হলো। সঙ্গে আপলোড করা হলো ২৩টি প্রয়োজনীয় কাগজ। আবেদনের তিন দিনের মধ্যে যাচাই করা হলো। সব কাগজ সঠিক পাওয়া গেল। এবার কারখানা পরিদর্শনের পালা। আবেদনকারীকে অনলাইন থেকে মেইলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানিয়ে দেয়া হলো কারখানা পরিদর্শনের সময়। পরিদর্শন শেষে প্রস্তুত হলো লাইসেন্স। আবার অনলাইনেই জানানো হলো, আপনার লাইসেন্স তৈরি, সই করে লাইসেন্স নিয়ে যান। ব্যবসায়ী সই করে নিয়ে গেলেন লাইসেন্স। কারখানা পরিদর্শন আর লাইসেন্স নিতে সই ছাড়া একবারের জন্যও কর্মকর্তার সঙ্গে ব্যবসায়ীর দেখা হয়নি। দিতে হয়নি কোনো প্রকার ঘুষ, হতে হয়নি হয়রানির শিকার। ধরতে হয়নি দালাল। অবিশ্বাস্য লাগছে? তবে অবিশ্বাস্য নয়, সত্যি। অনলাইনে বন্ড লাইসেন্স আবেদন করলে ঘুষ ছাড়াই লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে। লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ভাষ্য এমন। ঢাকা কাস্টমস বন্ড (দক্ষিণ) কমিশনারেট থেকে সম্প্রতি অনলাইনে তিনটি লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। ২৫টি লাইসেন্স প্রক্রিয়াধীন।

বন্ড কর্মকর্তারা বলছেন, অনলাইনে আবেদন করার পর সবই হয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। একমাত্র কারখানা পরিদর্শনের সময় ছাড়া প্রতিষ্ঠানের কারও সঙ্গে দেখা হয় না বন্ড কর্মকর্তাদের। ফলে ঘুষ লেনদেনের যে অভিযোগ, তা তোলার সুযোগ নেই। লাইসেন্সের চাহিদামতো কাগজপত্র থাকলে প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পেতে নিশ্চিত থাকতে পারে। বন্ড অটোমেশনের কাজ শেষ হলে বন্ড-সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ থাকবে না বলে মনে করেন কর্মকর্তারা। লাইসেন্সসহ বন্ডের অন্যান্য কাজ দ্রুত অনলাইনভিত্তিক করার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

এনবিআর সূত্রমতে, বন্ড লাইসেন্স পেতে হলে কোটি টাকা খরচ করতে হয়। ধরতে হয় দালাল। এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তবে বেশিরভাগ সময় প্রতিষ্ঠান আবেদনের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিতে পারে না। আবার কাগজপত্র দিলেও তা ঠিক থাকে না। কারখানায় যে যন্ত্রপাতি থাকার প্রয়োজন, তা থাকে না। ফলে আবেদন করার পর তা বাতিল হয়। মাসের পর মাস ঘুরতে হয়। বাধ্য হয়ে প্রতিষ্ঠান দালালকে টাকা দিয়ে লাইসেন্স করে। ফলে লাইসেন্স পেতে প্রতিষ্ঠানকে ঘুষ গুনতে হয় কোটি কোটি টাকা। লাইসেন্স নিয়ে কোনো অভিযোগ যাতে না ওঠে, সে বিষয়টি নিয়ে কাজ করার নির্দেশ দেন চেয়ারম্যান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বন্ড অটোমেশনের আওতায় অনলাইনে লাইসেন্স আবেদন মডিউল চালু করা হয়। বন্ড দুভাগ হওয়ার পর প্রথমবার বন্ড দক্ষিণ আবেদন আহ্বান করে। এরই মধ্যে ২৮টি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছে। এরই মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। তিনটি প্রতিষ্ঠান হলো নেচারাল ইন্ডিগো লিমিটেড, পানাম সাইকেল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও ওএমসি ফুটওয়্যার লিমিটেড। বাকি ২৫টি লাইসেন্স প্রক্রিয়াধীন।

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে লাইসেন্স আবেদন করতে হলে প্রতিষ্ঠানকে ২৩টি কাগজপত্র দিতে হয়। এসব কাগজ হালনাগাদ হতে হয়। লাইসেন্স পেতে হলে প্রতিষ্ঠানকে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। আবেদনের সঙ্গে এই তিনটি ডকুমেন্ট আপলোড করতে হয়। আবেদন করতে প্রতিষ্ঠানের কাউকে বন্ডে আসতে হয় না। আবেদন করার পর বন্ড থেকে সব ডকুমেন্ট সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে দ্রুত সময়ে যাচাই করা হয়। যাচাইয়ে সঠিক পাওয়া গেলে অনলাইনে প্রতিষ্ঠানের দেয়া ই-মেইলে প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের তারিখ জানানো হয়। পরিদর্শনে প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রপাতি ও কারখানা যথারীতি সঠিক পাওয়া গেলে লাইসেন্স অনুমোদন হয়ে যায়। মেইলে প্রতিষ্ঠানকে বিষয়টি জানানো হয়। তখন প্রতিষ্ঠানের মালিককে বন্ড অফিসে এসে সই করে লাইসেন্স নিতে হয়। লাইসেন্স অনুমোদনের সময় সর্বোচ্চ এক মাস। তবে প্রক্রিয়া সহজ করায় এখন ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে লাইসেন্স পাওয়া যাচ্ছে। পুরো প্রক্রিয়া বন্ড অফিস থেকে কঠোরভাবে মনিটরিং করা হয়, যাতে শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কর্মকর্তাদের সরাসরি সাক্ষাৎ না হওয়ায় অবৈধ লেনদেনের সুযোগ নেই। ফলে লাইসেন্স নিয়ে এত দিন ব্যবসায়ীদের মধ্যে যে ভয় ছিল, তা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। আর লাইসেন্স নিয়ে বন্ড অফিসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগ রয়েছে, তা দূর হবে বলে মনে করেন কর্মকর্তারা।

বন্ড ভাগে যুগান্তরকারী সাফল্য

বন্ড অফিস সূত্রমতে, বন্ডের প্রতিষ্ঠান ভাগ ছিল অ্যালফ্যাবেটিক্যালি বা বর্ণভিত্তিক। একজন কর্মকর্তাকে লাইসেন্সের ধরন অনুযায়ী কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকতে হতো। বর্ণভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় দেখা যেত একেক প্রতিষ্ঠান একেক জায়গায় বা একেক জেলায়। ফলে কর্মকর্তার পক্ষে প্রতিষ্ঠানকে সঠিকভাবে তদারকি করা সম্ভব হতো না। প্রতিষ্ঠান কাঁচামাল অবৈধ অপসারণ করলেও ধরা সম্ভব হতো না। প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক নিরীক্ষা অসম্পন্ন থেকে যেত। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি হওয়ায় ওই কর্মকর্তার পক্ষে সব প্রতিষ্ঠানে যাওয়া বা তদারকি করা সম্ভব হতো না। তবে বন্ড কমিশনারেটকে দুভাগ করার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানকে ক্লাস্টার পদ্ধতিতে ভাগ করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানকে সিটি করপোরেশন, জেলা, পৌরসভা, ওয়ার্ড ও ইউনিয়নভিত্তিক ভাগ করা হয়েছে। ফলে বন্ড প্রতিষ্ঠান যে ধরনের হোক না কেন, একজন কর্মকর্তা সহজে তদারকি করতে পারবেন। এক এলাকায় একজন কর্মকর্তা গেলে তিনি সব প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে পরিদর্শন করতে পারছেন। ঢাকা দক্ষিণ বন্ড কমিশনারেটের বর্তমান কমিশনার এই যুগান্তরকারী পদক্ষেপ নিয়ে প্রতিষ্ঠানকে ক্লাস্টারভিত্তিক ভাগ করেছেন। ফলে প্রতিষ্ঠান একদিকে যেমন উপকৃত হচ্ছে, অন্যদিকে অবৈধ অপসারণ কমে আসছে।

এক দিনে এইচএস কোড

বন্ড অফিস সূত্রমতে, এইচএস কোড সংযোজনের ক্ষেত্রে বন্ড অফিসের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ওঠে। বিশেষ করে এইচএস কোড সংযোজনের ক্ষেত্রে ঘুষ নেয়া, হয়রানি ও সময়ক্ষেপণ করা হয়। এতে প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। তবে এইচএস কোড সংযোজনের আবেদন সঠিক হলে দিনে দিনে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। প্রতিষ্ঠান তার প্যাডে শাখায় আবেদন করবে। আবেদন করার সঙ্গে সঙ্গে ফাইল দৌড়াতে থাকে। ডেপুটি কমিশনার থেকে কমিশনার হয়ে দ্রুত আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়। গত কয়েক মাসে এইচএস কোড নিয়ে কোনো অভিযোগ করেনি কেউ। সমস্যা থাকলে দুই-তিন সময় লাগে। সময় না থাকলে দিনে দিনে এইচএস কোড সংযোজনের অনুমোদন দেয়া হয়।

ডিপ্লোম্যাটিক বন্ডের অপব্যবহার বন্ধ

বন্ড অফিস সূত্রমতে, ডিপ্লোম্যাটিক বন্ড সুবিধায় আমদানি করা মদ ও সিগারেট বাইরে বিক্রি করে দেয়া হয়। এতে আমদানির যেমন হিসাব থাকে না, তেমনি আমদানি করা পণ্য কোথায় যায়, তারও হিসাব থাকে না। কারণ ডিপ্লোম্যাটিক বন্ডেড প্রতিষ্ঠানগুলো যাদের কাছে মদ ও সিগারেট বিক্রি করে, তা কোনো রেজিস্টারে উল্লেখ করত না। এতে বিপুল রাজস্ব হারাত সরকার। বর্তমানে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে কেনাবেচার তথ্য সফটওয়্যারে এন্ট্রি দিতে হয়। ফলে ডিপ্লোম্যাটিক বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের সুযোগ বন্ধ হয়েছে।

বন্ড সুবিধার অপব্যবহার রোধে আরও যত পদক্ষেপ

বন্ড অফিস সূত্রমতে, ঘুষ ছাড়া ইউপি অনুমোদন হয় নাÑএমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ইউপি শাখায় একসময় প্রকাশ্যে ঘুষ লেনদেন হতো। তবে ঢাকা দক্ষিণ বন্ড কমিশনারেট ইউপি শাখায় বহিরাগত ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের চলাচল নিষিদ্ধ করেছে। ফলে ঘুষ লেনদেন প্রায় জিরো পর্যায়ে চলে এসেছে। ইউপি অনুমোদন অনলাইনে দেয়া হবে। বন্ড অটোমেশনে ইউপি মডিউল সংযোজন করা হচ্ছে। ফলে প্রতিষ্ঠান অনলাইনে আবেদন করবে। যাচাই শেষে অনলাইনেই অনুমোদন দেয়া হবে। প্রতিষ্ঠানকে বন্ড অফিসে আসতে হবে না। এছাড়া প্রাপ্যতা আর বার্ষিক নিরীক্ষা নিয়ে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তবে কঠোর তদারকির ফলে নিরীক্ষা আর প্রাপ্যতা দেয়ার ক্ষেত্রে অভিযোগ কমে এসেছে। প্রতিষ্ঠানকে বন্ড-সংক্রান্ত তথ্য দিতে চেয়ারম্যানের নির্দেশে খোলা হয়েছে হেল্পডেস্ক।

কয়েকজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, অনলাইনের লাইসেন্স প্রক্রিয়া আরও সহজ করা হলে অভিযোগ জিরো পর্যায়ে চলে আসবে। এছাড়া প্রাপ্যতা, ইউপি, নিরীক্ষা সবই দ্রুত অনলাইন করা দরকার। বন্ড অফিসের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের যত কর্ম যোগাযোগ হবে, তত বেশি স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০