নিয়াজ মাহমুদ: গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধে গড়িমসি করছে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) কর্তৃক ট্রেডিং রাইট এনটাইটেলমেন্ট সার্টিফিকেট (ট্রেক) স্থগিত থাকা ‘সিলেট সিটি সিকিউরিটিজ লিমিটেড’। গত ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে গ্রাহকের সব দায়দেনা পরিশোধে কর্মপরিকল্পনা দাখিল করতে প্রতিষ্ঠানটিকে নির্দেশ দিয়েছিল সিএসই। এ সময়ের মধ্যে পরিকল্পনা জমা দিতে পারেনি সিকিউরিটিজ হাউজটি। এ কারণে নতুন করে সিএসইর কাছে সময় চেয়ে আবেদন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
জানা গেছে, গ্রাহকের দায়দেনা পরিশোধে সিএসইর নির্ধারিত স্বাধীন নিরীক্ষক এড়িয়ে নিরীক্ষক নিয়োগ দিয়েছে ব্রোকারেজ হাউজটি। এতে সিএসই ও সিলেট সিটির মধ্যে বিরোধ আরও ঘনীভ‚ত হয়। গত ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে গ্রাহকের সব দায়দেনা পরিশোধে কর্মপরিকল্পনা দাখিল করতে সিলেট সিটিকে নির্দেশ দেয় সিএসই। প্রতিষ্ঠানটি এ সময়ের মধ্যে পরিকল্পনা জমা দিতে ব্যর্থ হয়। সম্প্রতি সিএসইর কাছে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চেয়ে আবেদন করেছে সিলেট সিটি কর্তৃপক্ষ।
অন্যদিকে সিলেট সিকিউরিটিজ নিয়ে মিথ্যা ও অসংগতিপূর্ণ নিরীক্ষা কাজের জন্য ‘অমল অ্যান্ড লীনা’ অডিট ফার্মের পার্টনার অমল কৃষ্ণ দাসের নিরীক্ষা কাজে এক বছরের জন্য নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার সিএসইর চিফ রেগুলেটরি অফিসার (সিআরও) মোহাম্মদ শামসুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সিলেট সিটি সিকিউরিটিজ গ্রাহকের পাওনা পরিশোধে গড়িমসি করছে। সিএসই থেকে বারবার পরিকল্পনা চাওয়া হয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানটির কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন করে নিরীক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠানটির অডিট ফার্ম সময় চেয়েছে। আর আগের নিরীক্ষক অমল অ্যান্ড লীনা অডিট ফার্মকে জরিমানা ও নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে আইসিএবি থেকে আমরা চিঠি পেয়েছি।’
এদিকে অভিযোগের বিষয়ে সিলেট সিটি সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হাছিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘গ্রাহকের এক-তৃতীয়াংশ দায়দেনা পরিশোধ করা হয়েছে। তাদের বাকি পাওনা পরিশোধের কার্যক্রম চলছে। গ্রাহকের কাছ থেকে আমরা সময় চেয়ে নিয়েছি। ধীরে ধীরে সবার পাওনা পরিশোধ করা হবে।’
সিএসই অতিউৎসাহী হয়ে সিলেট সিটির ট্রেক স্থগিত করেছে অভিযোগ করে তিনি আরও বলেন, ‘সিএসই যেসব নিরীক্ষকের নাম প্রস্তাব করেছে, তাদের সম্মানী বেশি। আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী নিরীক্ষক নিয়োগ দিয়েছি। আমরা আদালতের কাছে সময় চেয়েছি; আদালত আমাদের এক বছরের সময় দিয়েছেন। আমরা আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করব।’
সিএসই সূত্রে জানা গেছে, গত ৯ জানুয়ারি আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক বিও হিসাবের অনিয়ম ও অসামঞ্জস্য দূর করতে সিএসইতে একটি যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। গ্রাহকের দায়দেনা পরিশোধের জন্য প্রতিষ্ঠানটিতে একজন স্বাধীন নিরীক্ষক নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। সভায় সিলেট সিটি সিকিউরিটিজ পরিচালকদের উপস্থিতিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।
পরবর্তীকালে গত ১০ এপ্রিল সিএসইতে আরেকটি যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১০ জন নিরীক্ষকের নাম প্রস্তাব করা হয়। এদের মধ্যে একজনকে নির্বাচনের জন্য সিলেট সিটিকে নির্দেশ দেয় সিএসই। কিন্তু গত জুনে এ ১০ জনের বাইরে একজনকে সিলেট সিটি নিয়োগ দেয়।
এদিকে আইসিএবি সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন আইন ভঙ্গের কারণে সিলেট সিকিউরিটিজ হাউজটির ব্যবসায়িক কার্যক্রমের ওপর ২০১৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর নিষেধাজ্ঞা দেয় সিএসই কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ব্রোকারেজ হাউজটির অডিট রিপোর্টে তা উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়া হিসাবমান অনুযায়ী দেনাদার ও অগ্রিমের তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
এমনকি ৩৬ কোটি ৭২ লাখ টাকার দেনাদার ও এক কোটি সাত লাখ টাকার পাওনাদারের হিসাবের সত্যতা যাছাই করা হয়নি। এছাড়া ফাইন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্টে বিএএস-১ পরিপালন না করা হলেও নিরীক্ষক তা উল্লেখ করেননি।
এসব গরমিল সত্তেও নিরীক্ষক তার ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে তা তুলে ধরেননি। এমনকি হিসাব সঠিক আছে বলে মন্তব্য করেছেন। এর আলোকে সিএসই আইসিএবিতে লিখিতভাবে জানায়। সিএসইর অভিযোগের আলোকে আইসিএবি চলতি বছরের ৬ আগস্ট অমল অ্যান্ড লীনা অডিট ফার্মকে কারণ দর্শানোর জন্য শোকজ করে। তবে ফার্মটি তার জবাব দিতে পারেনি। এ অবস্থায় আইসিএবি ফার্মটির পার্টনার অমল কৃষ্ণ দাসকে এক বছরের জন্য নিরীক্ষাকাজে নিষেধাজ্ঞা ও এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। আর তিন মাসের মধ্যে এই এক লাখ টাকা না দিলে নিষোধাজ্ঞা দুবছর হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট সিটি সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালকদের আত্ময়-স্বজন মিলে প্রায় ১২ হাজার বিনিয়োগকারীর পুঁজি আত্মাৎ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তদন্ত করে তৎকালীন নির্বাহী পরিচালককে জরিমানা করে। বিনিয়োগকারীদের টাকা ফিরিয়ে দিতে প্রতিষ্ঠানটিকে সময়ও বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে টাকা পরিশোধ না করে বরং উচ্চ আদালতের কাছে তিন মাসের সময় নেয় প্রতিষ্ঠানটি। ওই তিন মাস পর ছয় মাস করে তিনবারে আরও দেড় বছর সময় নেয় সিটি সিকিউরিটিজ। এ দীর্ঘ সময়েও বিনিয়োগকারীদের টাকা পরিশোধ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। আবার নতুন করে সময় চেয়ে আবেদন করলে আদালত তা খারিজ করে দেন। এছাড়া বিনিয়োগকারীদের পাওনা টাকা ও শেয়ার ফেরত দিতে গড়িমসি করছে।
সিএসইর তদন্তে এসব অভিয়োগের সত্যতা মিলেছে। এরপর নতুন করে বিনিয়োগকারীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেজন্য কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক ট্রেক সনদ স্থগিত করে সিএসই কর্তৃপক্ষ।
এদিকে সিএসইর একাধিক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, সিলেট সিটি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ আইনের তোয়াক্কা করছে না। বিনিয়োগকারীদের পাওনা ফেরত না দিয়ে নতুন করে অনিয়ম শুরু করেছে। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটির তদারকির দায়িত্ব হচ্ছে সিএসইর। কিন্তু তারা এ বিষয়ে সিএসইকে প্রতিবেদন দেয়নি ও যোগাযোগও করে না।
অন্যদিকে সিলেট মেট্রো সিটি সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপক, পরিচালক ও কর্মকর্তারা প্রায় ১২ হাজার বিনিয়োগকারীর পুঁজি আত্মসাৎ করে বলে অভিযোগ ওঠে। পরবর্তীতে আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক শামীম আহমেদকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। একই সঙ্গে শামীম আহমেদ পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আর কখনও থাকতে পারবেন না বলে নির্দেশ দেয় কমিশন।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের ২৫ নং ট্রেকহোল্ডার সিলেট সিটি সিকিউরিটিজ। সিলেট শহরেই প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম চলছে। প্রধান কার্যালয় ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটি সিলেট শহরের জিন্দাবাজার ও বন্দারবাজার শাখার মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল।