দিবসকেন্দ্রিক দেশপ্রেম

ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিতে ভরপুর আমাদের জš§ভূমি প্রিয় বাংলাদেশ। পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র জাতি, যে জাতির দামাল ছেলেরা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে; শুধু নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বাকস্বাধীনতা রক্ষার জন্য। ইতিহাসের পাতায় বাঙালি জাতি হিসেবে যে এক গৌরবোজ্জ্বল অহংকার আমাদের রয়েছে তা আজীবন স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। বাঙালির বাঙ্গালিয়ানা ও বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের দিবসের সংখ্যাটাও নিতান্ত কম নয়। আমরা প্রায়ই দেখতে পাই বিভিন্ন দিবস উদযাপনের কথা। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, বুদ্ধিজীবী দিবস, শিক্ষক দিবস, বাবা দিবস, মা দিবস, মাতৃভাষা দিবস, বাঙালির পহেলা বৈশাখসহ অসংখ্য সব দিবস। যে দিবসগুলো উদযাপন নিয়ে আমাদের হাজারো পরিকল্পনা ও উৎসব বিরাজ করে জনমনে। এমনকি আজকের এই যান্ত্রিকতাপূর্ণ জীবনে মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসে মা/বাবা দিবস পালন করছি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার (ভাইরাল হওয়া) মতো সব ছবি দিয়ে। অথচ সে দিনটাতেও আমার মা-বাবার খোঁজ নেয়ার সুযোগ পর্যন্ত হয় না! মা-বাবার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন কি শুধু দিবসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে?

দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে কেন্দ্র করে যে দিবসগুলো আমাদের রয়েছে, সেগুলোতেও দেখা যায় ওই নির্দিষ্ট দিনে শত শত কথার বুলি ফুটিয়ে শহীদ মিনার/স্মৃতিসৌধে ভোরবেলা খালি পায়ে হেঁটে গিয়ে ফুল দিচ্ছি, রমরমা এক পরিবেশের মধ্যে উদযাপন করছি দিবসগুলো। কিন্তু এই আমরাই আবার সারাবছর জুতা-স্যান্ডেল পরে শহিদ মিনারের ওপর হেঁটে বেড়াচ্ছি অবলীলায়! তখন আমাদের মনে বিন্দুমাত্র দেশপ্রেমের চেতনা জাগ্রত হয় না! মাতৃভাষা দিবসে দেশকে ভালোবাসি, ভাষাকে ভালোবাসি বলে মিডিয়া কাঁপাচ্ছি অথচ সেই আমরাই কি দিবস ব্যতীত ভাষার সেই সম্মান যথাযথভাবে প্রদর্শন করছি?

বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ, যা গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বহন করে সম্রাট আকবরের সময় থেকে যুগ যুগ ধরে পালিত হয়ে আসছে; সে নববর্ষ আজ আর গ্রামবাংলার ঐতিহ্য নেই! এটি হয়েছে শহরের ঐতিহ্য! আজ নববর্ষ উদযাপন করতে গিয়ে যে সকল পোশাক-পরিচ্ছদ ও বাঙালিয়ানা প্রদর্শন করা হয় সেগুলো উদযাপন করা গ্রামের সাধারণ মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়! যেখানে আজও দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভর করে জীবনযাপন করে এবং দেশের অর্থনীতির চাকা এগিয়ে নিয়ে যায় কৃষি ও কৃষক। যেখানে আজও সারাবছর শুধু পেঁয়াজ ও মরিচ দিয়ে পান্তা ভাত খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমাদের মুখে খাবার তুলে দেন। যেখানে তারা এক মণ ধান বিক্রি করে ১ কেজি ইলিশ কেনার টাকা আয় করতে পারেন না! সেখানে তারা কী করে নববর্ষ উৎপাদন করবেন? তারা তো সারাবছরই বাংলার ঐতিহ্য হƒদয়ে ধারণ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন অথচ তারাই দেশের সবচেয়ে অবহেলিত শ্রেণির মানুষ!

তাই দেশপ্রেম শুধু একটি দিবস বা দিনকে কেন্দ্র করে সে নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লোক দেখানো সংস্কৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না করে, সারাবছর যদি আমরা সেই ঐতিহ্য ও দেশপ্রেমকে হƒদয়ে ধারণ করে চলতে পারি তাহলেই তো আমরা হয়ে উঠব সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। আর স্বাধীনতার যে প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তথা স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে দিবস কেন্দ্রিক দেশপ্রেম থেকে বেরিয়ে না এলে আমাদের দেশের টাকা প্রতিনিয়তই অবৈধ পথে বিদেশে পারি দেবে, সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হবে তার মৌলিক অধিকার থেকে! আমরা কি আদৌ সেই দিবস কেন্দ্রিক দেশপ্রেম থেকে নিজেদের বের করে আনতে পারব?

আবু তালহা আকাশ

শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০