Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 1:41 pm

দুই আমদানিকারকের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

নজরুল ইসলাম: জুতা তৈরির মেশিন ও রুটি মেকার আমদানির জন্য এলসি খোলেন দুই আমদানিকারক। কিন্তু, তারা সেসব পণ্য আমদানি না করে আমদানি করেছেন উচ্চ শুল্কহারযুক্ত পণ্য সিগারেট। এখানেই থামেননি তারা, নিয়েছেন আরও জালিয়াতির আশ্রয়। অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে অবৈধ অনুপ্রবেশের মাধ্যমে পণ্য চালানের লক অবমুক্তও করা হয়েছে। খালাস করা হয়েছে সেসব পণ্য। দিয়েছেন সরকারের ১৬ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কর্মচারীরাও এতে জড়িত।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ দুটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। গত ১০ মার্চ দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে (চট্টগ্রাম-১) সহকারী পরিচালক (মানিলন্ডারিং) বিলকিস আক্তার মামলা দুটি দায়ের করেছেন।

এজাহারে বলা হয়েছে, ঢাকার হাতিরপুলের মিমি লেদার কটেজের মালিক গোলাম মোস্তফা ২০১৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তারিখে মার্কেন্টাইল ব্যাংক ঢাকার এলিফ্যান্ট রোড শাখায় হিসাব খোলেন। তিনি চীন থেকে মেশিনারি আমদানি করতে ২৬ সেপ্টেম্বর এলসি খোলেন। পণ্য চালানটি খালাসের জন্য মেসার্স এম অ্যান্ড কে ট্রেডিং করপোরেশনের (সিএন্ডএফ এজেন্ট) মোফাজ্জেল হোসেন মোল্লা ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করেন।

চালানটি আমদানির ক্ষেত্রে মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আত্মসাতের খবর পায় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। তারা কাস্টম হাউসকে বিষয়টি জানায়। অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে পণ্য চালানটি ১১ জুন লক করা হয়। লক থাকা অবস্থায় সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ফজলুল হকের চট্টগ্রামের ইউজার আইডির বিপরীতে ৮ ডিসেম্বর একটি লেনদেন করা হয়। ইউজার আইডিটির বিপরীতে ইস্যু করা আইপি এড্রেস দিয়ে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করেন আব্দুল গোফরান। ফজলুল হকের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড অপব্যবহারের সঙ্গে কাস্টম হাউসের কামরুল হক জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যায়। চালানটি ১৯ ডিসেম্বর তারিখে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারী জহুরুল ইসলাম অবমুক্ত করে। খালাসের জন্য চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো অনাপত্তিপত্র পাঠানো হয়নি। পণ্য চালানটির কায়িক পরীক্ষাও করা হয়নি। চালানটি শুল্কায়ন করেছেন শুল্কায়ন গ্রুপ-৮(বি) এর সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ওমর ফারুক ও রাজস্ব কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম। অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমের তথ্য অনুসারে চালানটি ১১ অক্টোবর শুল্কায়ন করা হয়। চালানটি খালাসকালে চট্টগ্রাম বন্দরের গেটে দায়িত্বরত ছিলেন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সাধন জিত চাকমা। তিনি গেট ভেরিফিকেশন দিয়ে খালাস দেন। পণ্য চালানটিতে আমদানি নীতি আদেশ লঙ্ঘন করে ঘোষণাবহির্ভূত উচ্চ শুল্ক হারযুক্ত পণ্য সিগারেট আমদানি করা হয়েছে। একটি ৪০ ফুট কনটেইনারে সাধারণত ৬৬ লাখ শলাকা সিগারেট আমদানি হয়ে থাকে। উন্নত ব্র্যান্ডের বেনসন অ্যান্ড হেজেস সিগারেটের ৬৬ লাখ শলাকা সিগারেটের ওপর আমদানি পর্যায়ে আদায়যোগ্য শুল্ক করের পরিমাণ ৮ কোটি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ১০০ টাকা। চালানটির বিপরীতে রাজস্ব পরিশোধ করা হয়েছে ১ কোটি ৩৮ লাখ ৯১৬ টাকা। পণ্য চালানটি জালিয়াতির মাধ্যমে খালাস করে অবশিষ্ট ৮ কোটি ১৮ লাখ ৫ হাজার ১৮৩ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে।

এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে, ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর থেকে ১৯ ডিসেম্বরের মধ্যে কেপিটাল মেশিনারি ফর সু মেকিং মেশিনের পরিবর্তে মিথ্যা ঘোষণায় উচ্চ শুল্কহারযুক্ত পণ্য সিগারেট আমদানি করেছে। দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারাসহ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারায় মামলাটি (নম্বর ২৮) দায়ের করা হয়েছে।

মামলাটিতে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মিমি লেদার কটেজের মালিক গোলাম মোস্তফা, মেসার্স এম অ্যান্ড কে ট্রেডিং করপোরেশনের (সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট) মালিক মোফাজ্জেল হোসেন মোল্লা, অনুপ্রবেশকারী আব্দুল গোফরান ও জহুরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সহকারী প্রোগ্রামার কামরুল হক, এআইআর শাখার রাজস্ব কর্মকর্তা সুলতান আহম্মদ, কম্পিউটার অপারেটর ফিরোজ আহমেদ, উচ্চমান সহকারী আব্দুল্লাহ আল মাছুম এবং অফিস সহায়ক সিরাজুল ইসলামকে আসামি করা হয়েছে।

পাবনা সদরের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এস কে এস এন্টারপ্রাইজের রাসেদুল ইসলাম কাফি ২০১৮ সালের ১৫ এপ্রিল সিটি ব্যাংক পাবনা শাখায় হিসাব খোলেন। তিনি ভারত থেকে রুটি মেকার আমদানির জন্য ৮ অক্টোবর এলসি (ঋণপত্র) খোলেন। এম এন্ড কে ট্রেডিং করপোরেশনের (সি অ্যান্ড এফ এজেন্ট) মালিক মোফাজ্জেল হোসেন মোল্লা ৪ অক্টোবর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করেন। মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি দেয়ার খবর পায় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। তারা চালানটির খালাস কার্যক্রম স্থগিত রাখার জন্য বলে। অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে পণ্য চালানটি লক করা হয়। কিন্তু জালিয়াতির মাধ্যমে লক অবমুক্ত করা হয়। এতে জহুরুল ইসলাম ও কামরুল হকের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যায়। ১৯ ডিসেম্বর জালিয়াতির মাধ্যমে চালানটি খালাস নেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে কাস্টম হাউসের ১৮ ডিসেম্বর অনাপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে তারা পণ্য ছাড় দিয়েছে। অনাপত্তিপত্র প্রস্তুত, ইস্যু, ডেসপাচ ও বিতরণের সঙ্গে রাজস্ব কর্মকর্তা (এআইআর) সুলতান আহম্মদ, কম্পিউটার অপারেটর ফিরোজ আহমেদ, উচ্চমান সহকারী আব্দুল্লাহ আল মাছুম ও অফিস সহায়ক সিরাজুল ইসলাম জড়িত ছিলেন। পণ্য চালানটির কায়িক পরীক্ষাও করা হয়নি। চালানটি শুল্কায়ন করেছেন শুল্কায়ন গ্রুপ-৯(এ) এর সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মির্জা সাঈদ হাসান ফরমান ও রাজস্ব কর্মকর্তা জিন্নাতুল ফেরদৌস।

অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমের তথ্য অনুসারে চালানটি ৪ নভেম্বর শুল্কায়ন করা হয়। পণ্য চালানটি খালাসকালে চট্টগ্রাম বন্দরের গেটে দায়িত্বরত ছিলেন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আফতারুল ইসলাম। চালানটিতে একটি ৪০ ফুট কনটেইনারে নেট ওয়েট ১২৭২৭ কেজি ‘রুটি মেকার’ উল্লেখ থাকলেও শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর বলছে, ঘোষণাবহির্ভূত উচ্চ শুল্ক হারযুক্ত পণ্য সিগারেট আমদানি করা হয়েছে। পণ্যচালানটিতে আদায়যোগ্য শুল্ক করের পরিমাণ ৮ কোটি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ১০০ টাকা। চালানটির বিপরীতে রাজস্ব পরিশোধ করা হয়েছে ৪ কোটি ৩৭ লাখ ৯৮৭ টাকা। পণ্য চালানটি জালিয়াতির মাধ্যমে খালাস করে অবশিষ্ট ৮ কোটি ১৫ লাখ ৬ হাজার ১১২ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে।