দুই ক্যাডার-ই চাই নিজেদের মধ্য থেকে ‘চেয়ারম্যান’

** ‘অনভিজ্ঞ কর্মকর্তাকে’ এনবিআরের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ প্রদান করায় ক্রমেই অকার্যকর হয়েছে এনবিআরের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো
** রাজস্ব প্রশাসনে গতিশীলতা আনয়নে বিদ্যমান অবকাঠামো পুনর্গঠনের মাধ্যমে এনবিআর জৈষ্ঠ্য সদস্যদের মধ্য হতে অভিজ্ঞতালব্ধ একজনকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত করা এখন সময়ের দাবি

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক: দেশের অক্সিজেন তথা রাজস্ব আহরণ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সেই অক্সিজেন আহরণে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই নিষ্পেষিত, অবহেলিত ও বঞ্চনার শিকার। সময়মত পদোন্নতি নেই, মেধার মূল্যায়ন নেই, সঠিক জায়গায় পদায়ন নেই, অটোমেশন নেই, সংস্কার নেই—এক দপ্তরে এমন নেই নেই কেবল একটি কারণে। তাহলো—এনবিআর চেয়ারম্যান। এনবিআর চলে মূলত দুইটি ক্যাডারের (কর, শুল্ক ও আবগারি) উপর ভর করে। কিন্তু এনবিআর পরিচালনা করেন প্রশাসন ক্যাডার থেকে আসা একজন সচিব। এই সচিব দুই বছরের জন্য নিয়োগ হলেও এই আমলা শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর সম্পর্কে জেনে উঠতে উঠতে দুই বছর লেগে যায়। যার ফলে এনবিআরকে দেয়ার মতো এই কামলার কিছুই থাকে না। সেজন্য এই দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চরম বৈষম্যের শিকার হন। বৈষম্য নিরসনে এবার দুই ক্যাডার থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগের দাবি জানানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার এই দুই ক্যাডার কর্মকর্তাদের পৃথক বৈঠকে শেষে এসব দাবি জানানো হয়েছে।

সূত্রমতে, বৃহস্পতিবার সকালে এনবিআর সম্মেলন কক্ষে বিসিএস (কাস্টমস এন্ড ভ্যাট) অ্যাসোসিয়েশনের ‘নতুন বাংলাদেশ বিনির্মানে করণীয়’ নির্ধারনকল্পে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় কাস্টমস ও ভ্যাট অনুবিভাগের সদস্য, কমিশনার, ক্যাডার সদস্যসহ সকলস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় বৈষম্যবিরোধী গণঅভ্যুথানে শহীদ ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করা হয়। সভা শেষে সভাপতি ড. মো. সহিদুল ইসলাম ও মহাসচিব একেএম নুরুল হুদা আজাদ সই করা বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। যাতে বলা হয়, দেশের উন্নযনের মূল চালিকাশক্তি রাজস্বের সিংহভাগ যোগানদাতা এনবিআরের কাস্টমস ও ভ্যাট অনুবিভাগ কর্তৃক রাষ্ট্র পরিচালনায় গঠিতব্য নতুন উপদেষ্টা কমিটিকে সর্বাত্নক সহযোগিতাসহ সর্বোচ্চ রাজস্ব যোগানের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের চাকাকে বেগবান করার জন্যে উপস্থিত সকলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত কাস্টমস ও ভ্যাট অনুবিভাগের সকল দপ্তর, শুল্ক স্টেশন ও বন্দরসমূহের সুরক্ষা নিশ্চিতকল্পে করণীয় ও এ বিভাগের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিভিন্ন বিষয়েও আলোচনা করা হয়।

আরও বলা হয়, উন্নযনের সাথে তাল রেখে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সুনিশ্চিতকরণ ও রাজস্ব প্রশাসনে গতিশীলতা আনয়নে বিদ্যমান অবকাঠামো পুনর্গঠনের মাধ্যমে এনবিআর জৈষ্ঠ্য সদস্যদের মধ্য হতে অভিজ্ঞতালব্ধ একজনকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত করা এখন সময়ের দাবি বলে সভায় যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়। অধিকন্তু সেবাগ্রহীতার সন্তুষ্টি অর্জন নিশ্চিতকরণ, ক্যাডার সম্প্রসারণ কার্যক্রম আশুভিত্তিতে সম্পন্নকরণ, দ্রুত পদোন্নতিযোগ্য সকল পদ পূরণ, চলতি দায়িত্বের অবসান, ইউনিফর্ম চালুসহ অন্যান্য বিভিন্ন বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়। শেষে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মানে ছাত্র জনতার উত্থাপিত প্রস্তাবনার সাথে একাত্মতা ঘোষণাসহ তা বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়।

সভা শেষে সভা শেষে সংগঠনের সদস্য ও চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনার সৈয়দ মুসফিকুর রহমান বলেন, আপনারা জানেন যে, আমাদের ভাবমূর্তিতেও বেশ কিছু টেন্ড হয়েছে। এই নিয়েও আমরা আলোচনা করেছি যে কিভাবে তা সংশোধন করা যেতে পারে। দেশে নতুন একটা ব্যবস্থা প্রবর্তিত হতে যাচ্ছে। রাষ্ট্র মেরামতের যে প্রস্তাব এসেছে, সেখানে আমরাও আমাদের কন্টিভিউশন রাখতে চাই। একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে যে, রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা রয়েছেন, তারাও যেন নি:সংকোচচিত্তে, অকুতভয়ে কাজ করতে পারেন। এখন যে আমাদের নিরাপত্তা সংকট যাচ্ছে—এই সংকট নিয়েও আমরা আলোচনা করেছি। আমাদের কয়েকটি শুল্ক স্টেশনে লুট হয়েছে। আমরা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি যে কিভাবে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে সেগুলো সুরক্ষা দিতে পারেন। আমাদের এখানে আইআরডি ও এনবিআর—এই জায়গায় একসঙ্গে কাজ করতে আমাদের অনেক সমস্যা হয়। সার্ভিস ডেলিভারি দ্রুত করতে হয় তাহলে এই দুই জায়গায় দৌড়াদোড়ি করতে হয়। যেহেতু একই ব্যক্তি চেয়ারম্যান ও একই ব্যক্তি সচিব, সেখানে কিন্তু সমস্যা হচ্ছে। এক কাজ দুইবার অনুমোদন করা লাগতেছে। সেখানে আমাদের প্রস্তাব রয়েছে যে—সেখানে আমরা মার্জ করে একটা রেভিনিউ ডিভিশন করবো। এই বিষয়ে আমরা কর ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও আলোচনা করেছি। তারাও এই বিষয়ে সম্মত আছেন।

অপরদিকে, একইদিন এনবিআরের চতুর্থ তলায় বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (ট্যাক্সেশন) অ্যাসোসিয়েশনের এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি ও কর কমিশনার মো. লুৎফুল আজীম। সভায় সংগঠনের মহাসচিব ও এনবিআরের প্রথম সচিব শেখ শামীম বুলবুল, এনবিআর সদস্যসহ সংগঠনের অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে সভাপতি মো. লুৎফুল আজীম বলেন, সভার প্রথমেই বৈষম্যবিরোধী গণঅভ্যূত্থানে আত্মাহুতি দেয়া সকল শহীদ বীরদের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা ও তাঁদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করা হয়। একইসঙ্গে তাদের শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা জানানো হয়। জাতীয় অর্থায়নে প্রধানতম বিভাগ হিসেবে এনবিআরের নেতৃত্বে কর বিভাগের সংস্কারসহ চলমান রাজস্ব বাজেট লক্ষ্যমাত্রা পূরণে করণীয় নির্ধারণপূর্বক দেশ থেকে অবৈধ ও বেআইনিভাবে পাচার করা অর্থ পুনরুদ্ধারের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্র মেরামতের নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় বাস্তবায়নের প্রধানতম চ্যালেঞ্জ জাতীয় রাজস্ব আহরণ। বিদ্যমান বাস্তবতায় কর বিভাগ জাতীয় স্বার্থে এ চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নে মানসিকভাবে প্রস্তুত। তবে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এবং কর বিষয়ে ‘অনভিজ্ঞ কর্মকর্তাকে’ এনবিআরের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ প্রদান করায় ক্রমেই অকার্যকর হয়েছে এনবিআরের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। ফলে বিদ্যমান দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো নিয়ে অর্থনীতি পুনর্গঠনের এ চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নে কার্যকর, পেশাদার ও দক্ষ রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে একটি আধুনিক এনবিআর গঠন করা প্রয়োজন।

সভাপতি বলেন, বর্তমান এই নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থায় বাস্তবসম্মত যৌক্তিক লক্ষ্যমাত্রা ও আদায় কার্যক্রম নিশ্চিত করতে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা পূনর্গঠনের মাধ্যমে কর বিভাগ যাত্রা শুরু করতে চায়। এর প্রথম ধাপ হিসেবে এনবিআরের চেয়ারম্যান পদে রাজস্ব ব্যবস্থাপনার কাজে দীর্ঘ অভিজ্ঞতালব্ধ এনবিআরের সদস্যদের মধ্য থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগ প্রদান আশু প্রয়োজন। এনবিআরের কর বিভাগের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শত প্রতিকূলতার মাঝেও কাজ করে যাচ্ছে। এনবিআরের কর বিভাগ রাজনৈতিক হাতিয়ারের অর্ন্তভূক্ত না হয়ে উন্নত রাজস্ব প্রশাসন বিনির্মাণের প্রত্যয় ব্যক্ত করছে এবং সকলের পূর্ণ সহযোগিতা কামনা করছে। সবশেষে ছাত্র-জনতার রাষ্ট্র মেরামতের যুগোপযোগী দাবির সাথে একাত্ম হয়ে দেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে কর বিভাগ বদ্ধ পরিকর।

অপরদিকে, বৈষম্য নিরসনে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের এনবিআরে প্রেষণে না দেয়া এবং দুই ক্যাডার থেকে চেয়ারম্যান দেয়ার দাবি জানিয়েছেন দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা। একইসঙ্গে বর্তমান চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, তার তিন প্রথম সচিবের (মো. শাহিদুজ্জামান, ঈদতাজুল ইসলাম ও গাউসুল আযম) পদত্যাগ, পদোন্নতি ও অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার দাবি করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার এনবিআর প্রাঙ্গণে পৃথক সংগঠনের ব্যানারে বিক্ষোভে এসব দাবি জানানো হয়েছে।


বিষয় ➧

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০