কুদরতে খোদা সবুজ, কুষ্টিয়া: কুষ্টিয়া শহরের কোলঘেঁষে বয়ে যাওয়া গড়াই নদীতে নাব্য ফিরিয়ে আনতে দুই দফা খনন করা হলেও তেমন কোনো সুফল মেলেনি। বছরের প্রায় অর্ধেক সময়ই পানিপ্রবাহ অস্বাভাবিকভাবে কমে যাচ্ছে। তৃতীয়বারের মতো গড়াই খননে হাতে নেওয়া হচ্ছে নতুন প্রকল্প।
জানা যায়, আগের তুলনায় শুষ্ক মৌসুমে মিঠাপানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গত কয়েক বছরে খুলনা, যশোরসহ কয়েকটি জেলায় নদী অববাহিকায় স্যালাইনিটি (নোনাপানি) বেড়েছে। পরিবেশবিদদের মতে, খুলনা বিভাগের মধ্যে পরিবেশগত দিক থেকে পদ্মার প্রধান শাখা নদী গড়াইকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতেও গড়াই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষ করে সুন্দরবনের জন্য গড়াইয়ের মিঠাপানি অপরিহার্য। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হরিপুর ও মিরপুর উপজেলার তালবাড়িয়া এলাকার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা থেকে গড়াই উৎসমুখ শুরু হয়েছে। নদীটি কুষ্টিয়া ছাড়াও মাগুরা, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ ও ফরিদপুর হয়ে যশোর ও খুলনা হয়ে সুন্দরবনে গিয়ে মিশেছে। সুন্দরবন ছাড়াও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে নোনাপানির আগ্রাসন রুখতে বড় ভূমিকা রাখে গড়াইয়ের মিঠাপানি। বর্ষা মৌসুমে গড়াই নদীর দুই কূল পানিতে উপচে পড়লেও শুষ্ক মৌসুমে নদীর চেহারা একেবারেই ভিন্ন। খনন কাজ চলার পরও শুষ্ক মৌসুম এলে দেখা যায় পানি শুকিয়ে প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে নদীর অবস্থা একেবারেই করুণ।
কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী মহাসড়কের লাহিনী এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, গড়াই শুকিয়ে গেছে। কোনো প্রবাহ নেই। আর উৎসমুখ তালবাড়িয়া থেকে শুরু করে লাহিনী এলাকা পর্যন্ত নদীতে বিপুল পরিমাণ পলি ও বালু জমেছে। দেড় যুগ আগেই পলি ও বিপুল বালু জমে গড়াই নদীতে পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়।
গড়াইকে আগের রূপে ফিরিয়ে আনতে ১৯৯৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গড়াই খননের কাজ উদ্বোধন করেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই বৃষ্টির পানিতে মাটি ও বালিতে নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় ওই কাজে আর কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। পরের বছর এ নদী পুনরুদ্ধারে ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে অপর একটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। নেদারল্যান্ডসের কোম্পানি জিআরসি’র মাধ্যমে জোরেশোরে এ কাজটি শুরু হয়। জিআরসি’র কাজ শেষ হওয়ার কয়েক বছর যেতে না যেতে ফের গড়াই একেবারে মরা খালে পরিণত হয়।
বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর গড়াই নদীর পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখা, এলাকার খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষা করা, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা, সুন্দরবন এলাকার লবণাক্ততা দূরীকরণ, দক্ষিণাঞ্চলের মিষ্টি পানির প্রবাহ বৃদ্ধি, সেচ সহযোগিতা প্রদান, মৎস্য চাষ সুবিধা, সুন্দরবনের বৃক্ষরাজির উৎপাদন বৃদ্ধি, কুষ্টিয়া, যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, ফরিদপুর, যশোর ও খুলনা এলাকাকে মরূকরণের হাত থেকে রক্ষাসহ আরও বেশ কয়েকটি লক্ষ্য নিয়ে ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে চার বছর মেয়াদি বৃহত্তর আকারের ড্রেজিং করতে ‘গড়াই নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্প-২’ গ্রহণ করে।
ওই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯৪২ কোটি টাকা। ওই প্রকল্পের আওতায় কুষ্টিয়ার গড়াই নদীর মুখ থেকে শুরু হয়ে কুমারখালী উপজেলার নন্দলালপুর ইউনিয়ন পরিষদ অফিস পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ৪০ মিটার প্রস্থ গড়াই নদীর ৯৩ লাখ ঘনমিটার মাটি খনন করা হয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ের মেয়াদে তালবাড়িয়া থেকে খোকসা উপজেলা শহর পর্যন্ত মোট ৩০ কিলোমিটার নদী খননে ৫০৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়ে গেলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তারপরও পানি উন্নয়ন বোর্ড ১৭ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে আপৎকালীন খনন কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য, যা এখন চলমান রয়েছে।
এদিকে নতুন করে তৃতীয় ধাপের খনন কাজ করতে একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। একনেকে পাস হলে তৃতীয় ধাপে ফের বড় পরিসরে খনন কাজ করার কথা ভাবছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পাশাপাশি নদীকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে তৈরি করা হবে একাধিক গাইড বাঁধ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ভৌগোলিক কারণে গড়াই নদীতে প্রচুর পরিমাণে পলি ও বালু জমে। এছাড়া ভাঙনের কারণেও নদীর প্রশস্ততা বাড়ছে দিন দিন। এজন্য বর্ষা মৌসুমে অধিক পরিমাণে বালি জমে উঁচু হয়ে উঠছে নদীর বুক। এতে পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে নদীকে সচল করতে ২৫ ফুট চওড়া করে কোনো রকমে ক্যানেলের আকারে খনন করা হচ্ছে, যাতে অন্তত
পানিপ্রবাহ সচল হয়।
কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান জানান, দুই দফা খননের পরও নদীতে পানিপ্রবাহ আগের মতো নেই। নতুন করে একটি প্রকল্প পাঠানো হয়েছে। আশা করা হচ্ছে এ বছরেই প্রকল্পটি পাস হবে। গড়াই বঁাঁচাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। এছাড়া গবেষণারও ঘাটতি আছে। বৃহৎ পরিকল্পনা হাতে নিলে এ প্রকল্প থেকে সুফল মিলবে। বর্তমানে নদীকে সচল করতে খননকাজ চলছে। প্রবাহ স্বাভাবিক হয়ে যাবে আশা করছি।
পরিবেশ ও নদী গবেষক কুষ্টিটয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (্ইবি) অধ্যাপক ড. রেজওয়ানুল ইসলাম বলেন, গড়াই এ এলাকার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। তাকে বাঁচাতে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। গড়াই না বাঁচলে এ অঞ্চল থেকে অনেক মাছ ও জলজ প্রাণী হারিয়ে যাবে। ইতোমধ্যে অনেক পাখি ও মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।