ইসমাইল আলী: পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বর্তমানে দেশের সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র। ৬৬০ মেগাওয়াট করে দুই ইউনিটের কেন্দ্রটির উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট। যদিও উৎপাদন শুরুর পর গত দুই বছরে এর সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার হয়নি। উল্টো অত্যধিক উৎপাদন ব্যয়ের জন্য গুনতে হয়েছে মোটা অঙ্কের লোকসান। আর এ লোকসান তথা উৎপাদন ব্যয়ের পেছনে রয়েছে উচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জ, যা কেন্দ্রটি বসিয়ে রেখেই দিতে হচ্ছে।
এদিকে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ শেষ না হওয়ায় বাধ্য হয়েই কেন্দ্রটির একটি ইউনিট নিয়মিত বন্ধ রাখতে হচ্ছে। অপর ইউনিটের সক্ষমতারও পূর্ণ ব্যবহার করা হচ্ছে না। এতে ক্যাপাসিটি চার্জের প্রায় অর্ধেকই গচ্চা যাচ্ছে। এছাড়া নির্মাণব্যয় বৃদ্ধির যুক্তিতে গত অর্থবছর কেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যমতে, পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সক্ষমতার ৮০ শতাংশ (প্যান্ট ফ্যাক্টর) ব্যবহার করা হবে বলে ধরে নিয়ে লাইসেন্স দেয়া হয়। এর প্রথম ইউনিটটি উৎপাদনে আসে ২০২০ সালের ১৫ মে, আর দ্বিতীয় ইউনিটটি উৎপাদন শুরু করে একই বছর ৮ ডিসেম্বর।
২০২০-২১ অর্থবছর এ কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় ৩৮১ কোটি ১৯ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। অর্থাৎ সক্ষমতার ৪৩ শতাংশ ব্যবহার হয়। যদিও কেন্দ্রটির জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয় এক হাজার ৯৯৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা। আর ওই অর্থবছর পায়রা কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয় তিন হাজার ৩৭৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এতে মোট ব্যয় হয় তিন হাজার ৩৭৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। আর ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় পরে আট টাকা ৮৬ পয়সা। তবে এ বিদ্যুতের বিক্রয়মূল্য ছিল পাঁচ টাকা ১২ টাকা। এতে ২০২০-২১ অর্থবছর কেন্দ্রটিতে পিডিবির লোকসান হয় এক হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা।
এদিকে ২০২১-২২ অর্থবছর কেন্দ্রটির সক্ষমতার মাত্র ৩৪ শতাংশ ব্যবহার হয়। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় ৩৯৩ কোটি ১৩ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এ সময় কেন্দ্রটির জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে দুই হাজার ৭১৪ কোটি ২২ লাখ টাকা। আর গত অর্থবছর পায়রা কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে মোট ব্যয় হয় ছয় হাজার ১৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এতে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় পড়ে ১৫ টাকা ৭২ পয়সা। তবে এ বিদ্যুতের বিক্রয়মূল্য ছিল পাঁচ টাকা আট পয়সা। এতে ২০২১-২২ অর্থবছর কেন্দ্রটিতে পিডিবির লোকসান হয় দুই হাজার ৯৮৭ কোটি ৩১ লাখ টাকা।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার না হলেও দুই বছরে কেন্দ্রটির জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় হয়েছে চার হাজার ৭১০ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। আর দুই বছরে কেন্দ্রটিতে লোকসান গুনতে হয়েছে চার হাজার ৪৮১ কোটি ৩১ লাখ টাকা। অর্থাৎ দুই বছরের লোকসান প্রায় ক্যাপাসিটি চার্জের সমান।
সূত্র জানায়, পায়রা কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রটির জন্য বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপনের কাজ করছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। তবে সঞ্চালন লাইন নির্মাণ শেষ হতে আরও বছর খানেক সময় লাগতে পারে। ফলে এই কেন্দ্র থেকে পুরো বিদ্যুৎ কেনা ছাড়াই আরও এক বছর ক্যাপাসিটি চার্জ গচ্চা দিতে হবে।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ শেয়ার বিজকে বলেন, পিজিসিবির ব্যর্থতার কারণেই সময়মতো পায়রার পুরো বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে আসছে না। বারবার তাগাদা দেয়ার পরও তারা সফল হয়নি। এজন্য পিডিবির পক্ষ থেকে পিজিসিবিকে জরিমানা করা হচ্ছে।
সূত্রমতে, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ যুক্ত করতে সঞ্চালন লাইন নির্মাণে তিনটি প্রকল্প নিয়েছে পিজিসিবি। তবে করোনা মহামারি ও পদ্মা নদীসহ কয়েকটি রিভার ক্রসিং (নদীর ওপর দিয়ে লাইন নির্মাণ) জটিলতার জন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া বলেন, কভিড মহামারির কারণে বিদেশ থেকে প্রকৌশলী আসতে ও মালপত্র ক্রয়ে সমস্যা হয়েছে। এজন্য ২০২০ ও ২০২১ সালে প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আসেনি। এছাড়া এই রুটে লাইন নির্মাণে পদ্মাসহ অসংখ্য নদী রয়েছে। রিভার ক্রসিং একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তবে আগামী জানুয়ারির মধ্যে পিজিসিবির কাজ শেষ হবে আশা করা যায়। ফলে দ্রুতই পায়রা কেন্দ্রটির পুরো বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা যাবে।
উল্লেখ্য, পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড (বিসিপিসিএল), যার যৌথ মালিকানায় রয়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) এবং চীনের ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন লিমিটেড (সিএমসি)।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে মোট বাজেট ধরা হয়েছিল ২৪৮ কোটি ডলার। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক ৮০ শতাংশ তথা ১৯৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার ঋণ দিয়েছে। অবশিষ্ট ২০ শতাংশ সমান হারে বিনিয়োগ করেছে এনডব্লিউপিজিসিএল ও সিএমসি।
যদিও বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণব্যয় পরে বেড়ে গেছে। এর মধ্যে কয়লা খালাসের জন্য পায়রা নদী ড্রেজিংয়ে অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে এক কোটি ডলার। এছাড়া কয়লা সংরক্ষণের জন্য তিনটির পরিবর্তে চারটি সংরক্ষণাগার নির্মাণ করা হয়েছে। এ খাতেও ব্যয় বেড়েছে। ফলে কেন্দ্রটির বার্ষিক ক্যাপাসিটি চার্জের হার বাড়ানো হয়েছে।