দুই বছরে লোকসান হবে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা!

ইসমাইল আলী: বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ হ্রাস ও আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি উৎপাদনে আসছে নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে বাড়ছে ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা। ভারতের আদানির বিদ্যুৎও আসা শুরু করবে শিগগিরই। এছাড়া বিদ্যুতের বাল্ক (পাইকারি) মূল্যের ওপর উৎসে করারোপের কারণে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে বিদ্যুতের বাল্ক মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব করা হলেও তা খারিজ করে দেয়া হয়েছে।

সব মিলিয়ে লোকসানের ডুবতে যাচ্ছে বিদ্যুৎ খাত। চলতি (২০২২-২৩) ও আগামী (২০২৩-২৪) অর্থবছর দুই বছরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) লোকসান গুনবে প্রায় এক লাখ ১৩ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা। সংস্থাটির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। গত সপ্তাহে বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহার বৃদ্ধির প্রস্তাব খারিজের পর এ প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করে পিডিবি। এতে বিদ্যুৎ খাতের বর্তমান পরিস্থিতি ও আগামী দুই বছরের সম্ভাব্য গতিবিধি তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছর দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের (সম্ভাব্য) পরিমাণ দাঁড়াবে পাঁচ হাজার ৭৮৮ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা। এজন্য জ্বালানি ব্যয় পড়বে ৫১ হাজার ৭৮০ কোটি ৬০ লাখ টাকা। আর ক্যাপাসিটি চার্জ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় হবে ২৭ হাজার ৭৯৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট উৎপাদন ব্যয় পড়বে ৭৮ হাজার ৫৭৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এ বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবির সম্ভাব্য আয় হবে ২৮ হাজার ৫৬০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পাশাপাশি অন্যান্য ব্যয় বাদ দিয়ে চলতি অর্থবছর পিডিবির সম্ভাব্য লোকসান দাঁড়াবে ৫১ হাজার ৮৫৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

এদিকে আগামী অর্থবছর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের (সম্ভাব্য) পরিমাণ দাঁড়াবে ছয় হাজার ৭৮৪ কোটি ৪০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এজন্য জ্বালানি ব্যয় পড়বে ৫৭ হাজার ৩০১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। আর ক্যাপাসিটি চার্জ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় হবে ৩৬ হাজার ৮৬০ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট উৎপাদন ব্যয় দাঁড়াবে ৯৪ হাজার ১৬২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এ বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবির সম্ভাব্য আয় হবে ৩৩ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা। এছাড়া অন্যান্য ব্যয় বাদ দিয়ে আগামী অর্থবছর পিডিবির সম্ভাব্য লোকসান দাঁড়াবে ৬১ হাজার ৬৭২ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

পিডিবির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, আগে পিডিবি বছরে যে পরিমাণ লোকসান গুনত, এখন এক মাসেই তার কাছাকাছি পরিমাণ লোকসান হচ্ছে। এর মূল কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরবরাহকৃত গ্যাসের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে বাধ্য হয়ে তেলের কেন্দ্র বেশি চালাতে হচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য অনেক বেড়ে গেছে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে তা আগামীতে দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অথচ বিদ্যুতের বাল্ক মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব খারিজ করে দেয়ায় আয় বাড়ানো যাচ্ছে না।

তারা আরও বলেন, নতুন বেশ কয়েকটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসছে। এতে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। এ কারণেও বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় বাড়বে। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে চায় না সরকার। আবার অর্থ মন্ত্রণালয়ও চাহিদা অনুযায়ী ভর্তুকি ছাড় করছে না। এরই মধ্যে গত পাঁচ মাসের জন্য প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকার বিল বকেয়া পড়ে গেছে। সব মিলিয়ে আগামী দুই বছর বিদ্যুৎ খাতের জন্য খুবই জটিল সময়।

পিডিবির প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় দাঁড়াবে ১৪ টাকা ১৭ পয়সা। আগামী অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়াবে ১৪ টাকা ৩১ পয়সা। তবে বিদ্যুতের বাল্ক মূল্য না বাড়ানোয় গড় বিক্রয় মূল্য পাঁচ টাকা ৯ পয়সা অপরিবর্তিত থাকছে। এতে দুই অর্থবছর প্রতি ইউনিটে বিদ্যুৎ বিক্রিতে লোকসান দাঁড়াবে ৯ টাকার বেশি।

যদিও গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ছিল আট টাকা ৮৬ পয়সা, যা ছিল দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। তবে চলতি অর্থবছর তা প্রায় ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছর দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ছিল ছয় টাকা ৫৮ পয়সা, ২০১৯-২০ অর্থবছর পাঁচ টাকা ৮৫ পয়সা, ২০১৮-১৯ অর্থবছর পাঁচ টাকা ৯৫ পয়সা, ২০১৭-১৮ অর্থবছর চার টাকা ৮৪ পয়সা, ২০১৬-১৭ অর্থবছর চার টাকা ৯০ পয়সা, ২০১৫-১৬ অর্থবছর পাঁচ টাকা ৫৫ পয়সা, ২০১৪-১৫ অর্থবছর ছয় টাকা ২৭ পয়সা এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছর ছয় টাকা ২৮ পয়সা।

পিডিবির তথ্যমতে, গত ১২ বছরে পিডিবি লোকসান গুনেছে প্রায় এক লাখ পাঁচ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১০-১১ অর্থবছর সংস্থাটির লোকসান ছিল চার হাজার ৬২০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছর ছয় হাজার ৬৯৩ কোটি ৩৪ লাখ, ২০১২-১৩ অর্থবছর পাঁচ হাজার ৪৩ কোটি ৮৪ লাখ, ২০১৩-১৪ অর্থবছর ছয় হাজার ৮০৯ কোটি ২৫ লাখ, ২০১৪-১৫ অর্থছর সাত হাজার ২৮২ কোটি ৯৯ লাখ, ২০১৫-১৬ অর্থবছর তিন হাজার ৮৭৩ কোটি ৭৫ লাখ, ২০১৬-১৭ অর্থবছর চার হাজার ৪৩৪ কোটি ৯০ লাখ, ২০১৭-১৮ অর্থবছর আট হাজার ৩৫৩ কোটি ৯৫ লাখ, ২০১৮-১৯ অর্থবছর আট হাজার ১৪১ কোটি ৩৪ লাখ, ২০১৯-২০ অর্থবছর সাত হাজার ৪৪৮ কোটি ৬৩ লাখ এবং ২০২০-২১ অর্থবছর ১১ হাজার ৭১৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।

এদিকে গত অর্থবছর পিডিবির লোকসানের হিসাব এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে ওই সময় সংস্থাটি ৩১ হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান গুনেছে বলে প্রাথমিক হিসাবে জানিয়েছে পিডিবি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০