নিজস্ব প্রতিবেদক: সোনা চোরাচালান থামছে না। কখনও বিমান, কখনও শরীর, কখনও বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে লুকিয়ে আনা হয় সোনা। তথ্য পেলে জব্দ করা হয়। আর তথ্য না পেলে অনায়াসে তা বেরিয়ে যায়। দেশের সবচেয়ে বেশি সোনা চোরাচালান হয় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে। কঠোর নজরদারি আর তল্লাশির পরও চোরাচালান থামছে না। এই বিমানবন্দর দিয়ে গত পাঁচ বছরে বিধিবহির্ভূত ও চোরাচালানের মাধ্যমে আসা এক হাজার ৮৮৬ কেজি সোনা জব্দ করেছে ঢাকা কাস্টম হাউস, যার মূল্য এক হাজার ২২৬ কোটি টাকা। শাহজালালের পর চট্টগ্রামের হযরত শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সোনা চোরাচালান হয়। এই বিমানবন্দর থেকে গত পাঁচ বছরে ২৫৫ কেজি সোনা জব্দ করেছেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কর্মকর্তারা, যার মূল্য প্রায় ১৬৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে সবচেয়ে বেশি সোনা চোরাচালান হয়ে বাংলাদেশে আসে।
ঢাকা কাস্টম হাউস সূত্রমতে, দেশের সবচেয়ে বেশি সোনা জব্দ বা উদ্ধার হয় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। দেশের সব বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরের মধ্যে সোনা চোরাচালানে এই বিমানবন্দর প্রসিদ্ধ। কোনো যাত্রী বিধিবহির্ভূত বা ঘোষণা ছাড়া আনলে সেই সোনা জব্দ করা হয়। আবার কখনও গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সোনা জব্দ করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি বিমান থেকে সোনা জব্দ করা হয়। তবে কখনও কখনও যাত্রীর ব্যাগ, শরীর ও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে লুকানো অবস্থা থেকে সোনা জব্দ করা হয়। যাত্রীর সঙ্গে আনা বিভিন্ন ইলেকট্রনিক পণ্য, মোবাইল ও অন্যান্য পণ্যের মধ্যে বিশেষ কায়দায় লুকানো অবস্থায় থাকা সোনাও জব্দ করা হয়। অনেক সময় যাত্রীর পাকস্থলী বা পায়ুপথে লুকানো অবস্থা থেকেও সোনা জব্দ করা হয়েছে।
ঢাকা কাস্টম হাউসের কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, উদ্ধার করা এই সোনা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেয়া হয়েছে। দাবিদার বা মামলাবিহীন উদ্ধার করা সোনা বাংলাদেশ ব্যাংকে স্থায়ীভাবে জমা দেয়া হয়। এছাড়া দাবিদার বা মামলাযুক্ত উদ্ধার করা সোনা বাংলাদেশ ব্যাংকে অস্থায়ী খাতে জমা দেয়া হয়। বিচারাদেশের রায় অনুযায়ী জব্দ করা সোনার বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হয়। বিচারাদেশের মাধ্যমে রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা স্বর্ণ অস্থায়ী খাত থেকে স্থায়ী খাতে জমা করা হয়। স্থায়ীভাবে জমা করা স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংক নিলামের মাধ্যমে প্রসেস করে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়।
সূত্র আরও জানিয়েছেন, ঢাকা কাস্টম হাউসের কর্মকর্তারা ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বিধিবহির্ভূত ও চোরাচালানের মাধ্যমে আনা এক হাজার ৮৮৬ কেজি সোনা জব্দ করেছেন। এই সোনার আনুমানিক মূল্য এক হাজার ২২৬ কোটি টাকা। জব্দ করা স্বর্ণের মধ্যে ৩৫৫ কেজি স্থায়ীভাবে এবং এক হাজার ২৪০ কেজি অস্থায়ীভাবে জমা করা হয়েছে। এছাড়া পাঁচ বছরে নিলামের মাধ্যমে ২৫০ কেজি সোনা বিক্রি করা হয়েছে, যার মূল্য ৯১ কোটি ৫০ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৩ টাকা।
অন্যদিকে চট্টগ্রামের হযরত শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সোনা চোরাচালান বা বিধিবহির্ভূতভাবে আসে। এই বিমানবন্দর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের আওতাধীন। কাস্টম হাউসের একটি ইউনিটের কর্মকর্তারা এই বিমানবন্দরে কর্মরত থাকেন। এই বিমানবন্দরে পাঁচ বছরে ২৫৫ দশমিক ১০৪ কেজি সোনা জব্দ করা হয়েছে, যার আনুমানিক বাজারমূল্য ১৬৩ কোটি ৫২ লাখ ৮২ হাজার ৫১ টাকা। জব্দ করা এই স্বর্ণ কাস্টমস প্রক্রিয়া শেষে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয়েছে।
কাস্টমস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিমানের আস, শৌচাগারসহ বিভিন্ন জায়গায় কৌশলে লুকিয়ে সোনা চোরাচালান হয়। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কিছু অংশ জব্দ হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জব্দ করা সম্ভব হয় না। তবে তল্লাশি ও নজরদারি বাড়ানোর ফলে চোরাচালান আগের চেয়ে কমেছে। অবৈধভাবে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। স্বর্ণের অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কাস্টম হাউস ও শুল্ক গোয়েন্দা নিয়মিত গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
‘ব্যাগেজ রুলস, ২০১৬’ অনুযায়ী, একজন যাত্রী সর্বোচ্চ ২৩৪ গ্রাম ওজন সমপরিমাণ স্বর্ণের বার আনতে পারেন। তবে এজন্য তাকে বিমানবন্দরে নেমেই কাস্টমসের নির্ধারিত ফরম পূরণ করে স্বর্ণের বিষয়টি জানাতে হবে এবং শুল্ককর পরিশোধ করতে হবে। বার আনার ক্ষেত্রে প্রতি ১১ দশমিক ৬৭ গ্রামের জন্য দুই হাজার টাকা করে শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। তবে কেউ ২৩৪ গ্রাম ওজনের বেশি আনলে কাস্টমস সোনা ও বহনকারীকে জব্দ করবে। এছাড়া কেউ যদি ঘোষণা না দিয়ে সোনা নিয়ে গ্রিন চ্যানেল অতিক্রম করতে থাকেন, তাহলে সেটা চোরাচালান হিসেবে গণ্য হবে। সে সময় তাকে শুল্ক ফাঁকি দেয়ার অভিযোগে শুল্ক এবং শুল্কের দ্বিগুণ পরিমাণ জরিমানা করা হবে। এ ক্ষেত্রে মামলার দীর্ঘসূত্রতায় সোনার বার পেতে অনেক সময় লাগতে পারে। তবে ঘোষণা দিয়ে নির্ধারিত শুল্ককর পরিশোধ করলে খুব সহজেই বহন করা স্বর্ণবারটি নিয়ে যেতে পারবেন যাত্রীরা।
কাস্টমস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কোনো ধরনের শুল্ককর না দিয়েই একজন যাত্রী সর্বোচ্চ ১০০ গ্রাম স্বর্ণালংকার আনতে পারবেন। তবে কোনো অলংকারের সংখ্যা ১২টির বেশি হবে না। কেউ যদি ১০০ গ্রামের বেশি স্বর্ণালংকার আনেন, সেক্ষেত্রে তাকে অতিরিক্ত প্রতি গ্রামের জন্য প্রায় দুই হাজার টাকা শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। তবে স্বর্ণালংকারের পরিমাণ অস্বাভাবিক বা বাণিজ্যিক বলে মনে হলে কাস্টমস তা জব্দ করবে। জব্দ হওয়া স্বর্ণালংকার পরবর্তী সময়ে শুল্ককর এবং জরিমানা আদায় করে ফেরত দেয়া হয়। তবে স্বর্ণালংকারের পরিমাণ চোরাচালান বলে মনে হলে সেক্ষেত্রে কাস্টমস সেগুলো জব্দ করে বাহকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করবে।