দুই ভাগ হচ্ছে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট

রহমত রহমান: রপ্তানিতে উৎসাহ আর ব্যবসার উন্নয়নে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ড লাইসেন্স দেয় সরকার। কিন্তু বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে আসছে। বিশেষ করে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করে পণ্য তৈরি না করে সরাসরি খোলাবাজারে বিক্রি করে দেয়। অনেক প্রতিষ্ঠান শুল্ককর ফাঁকি দিতে পণ্য রপ্তানি করে, কিন্তু টাকা দেশে আসে না। বন্ধ ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে কাঁচামাল আমদানির মাধ্যমেও বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করা হয়। তবে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটে জনবল সংকট আর প্রযুক্তি দুর্বলতায় বন্ডের অপব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া বন্ডেড প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিষ্ঠান নিয়মিত মনিটরিং ও অডিট করা সম্ভব হয় না।

বন্ডের অপব্যবহার রোধ আর সেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বর্তমান ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটকে দুই ভাগে (ঢাকা উত্তর কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট ও ঢাকা দক্ষিণ বন্ড কমিশনারেট) ভাগ করা হচ্ছে। কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠান নিয়মিত মনিটরিং আর অডিট করা গেলে রাজস্ব ফাঁকি বন্ধ হয়ে যাবে। এছাড়া বন্ডের অপব্যবহার রোধে বন্ড অটোমেশন করা হচ্ছে। আর বন্ডকে দুই ভাগ করার এনবিআরের নেয়া উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

এনবিআর সূত্রমতে, রপ্তানি কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০০০ সালের ১ নভেম্বর বন্ড কমিশনারেট গঠন করা হয়। শুরুতে শুধু ঢাকাতেই বন্ডের অফিস ছিল। ২০১০ সালের ১০ নভেম্বর চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত রপ্তানিকারকদের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কসংক্রান্ত জটিলতা এড়াতেই এ দুটি বন্ড কমিশনারেট গঠিত হয়। এখন কমিশনারেট দুটিতে রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে বন্ড লাইসেন্স, বার্ষিক অডিট, আমদানি প্রাপ্যতা, ইউপি ইস্যু করা হয়। এর বাইরে বিদেশি কূটনীতিকদের জন্য পাসবই ইস্যু ও ডিপ্লোমেটিক বন্ডের অডিট, সুপারভাইজড বন্ডের কার্যক্রম মনিটরিং করা হয়।

ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের হিসাব অনুযায়ী, এ কমিশনারেটের আওতাধীন মোট বন্ড লাইসেন্সের সংখ্যা ছয় হাজার ৬২৬টি। এর মধ্যে সচল রয়েছে তিন হাজার ১৩৯টি। অন্যদিকে সচল নেই তিন হাজার ৪৮৭টি।

এনবিআর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতিনিয়ত বন্ড লাইসেন্সের সংখ্যা বাড়ে, কিন্তু জনবলের সংখ্যা বাড়ে না। একজন বন্ড অফিসার বা সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার অধীনে এক থেকে দেড়শ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যার ফলে প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন, মনিটরিং ও  অডিট করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে করে প্রতিষ্ঠানগুলোতে বন্ডের অপব্যবহার বাড়ছে।

সেজন্য বর্তমান ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটকে দুই ভাগ করার উদ্যোগ নেয় এনবিআর। দুই ভাগ হলে বর্তমান ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট হবে দক্ষিণ (ঢাকা) কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। আর নতুন করে ঢাকা (উত্তর) কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট করা হবে। নতুন কমিশনারেটের জন্য জনবল অনুমোদন হয়ে গেছে।

কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, দুটি বন্ড কমিশনারেটের জন্য প্রতিষ্ঠান অনুযায়ী প্রতিটির ৩০০ জনের বেশি করে জনবল চাওয়া হয়েছিল। এতে করে প্রতিটি এআরও-এর অধীনে ১০ থেকে ১২টি প্রতিষ্ঠান থাকত। তাহলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নিয়মিত মনিটরিং, অডিট হতো। বন্ডের অপব্যবহার বন্ধ হয়ে যেত। নতুন কমিশনারেটের জন্য জনবল অনুমোদন হয়ে গেছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন হয়ে গেছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে অনুমোদনের পরপরই নতুন কমিশনারেটের কার্যক্রম শুরু হবে। দ্রুত অনুমোদনের জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ও এনবিআর থেকে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। ডিসেম্বরের পরপরই কমিশনার ও অফিসার পদায়নের পর অফিস নেয়া হবে। ২২০ জনবল অনুমোদন হয়েছে। তাদের জন্য অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ হাজার স্কয়ারের একটি অফিস লাগবে। কমিশনার পদায়নের পর তিনি অফিস ভাড়া, ডেকোরেশন সব করবেন।

কর্মকর্তাদের মতে, নতুন উত্তর কমিশনারেটের এলাকা উত্তরার পর থেকে শুরু হতে পারে। আর বিমানবন্দর থেকে দক্ষিণ কমিশনারেটের (বর্তমান ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট) এলাকা শুরু হতে পারে। উত্তরার পর থেকে বন্ডেড প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি।

এনবিআর সূত্রমতে, চলতি বছরের ১২ আগস্ট ঢাকা (উত্তর) কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট স্থাপনে সৃষ্টি করা পদের বেতনস্কেল নির্ধারণ করে পদের অনুমোদন দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ সই করা আদেশে বলা হয়, ঢাকা (উত্তর) কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট স্থাপনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২০২০ সালের ২৭ ডিসেম্বরের চিঠি ও চলতি বছরের ২২ জুন ব্যয় ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগের অনুমোদনে এনবিআরের আওতাধীন ঢাকা (উত্তর) কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট স্থাপনের জন্য রাজস্ব খাতে ২২০টি পদের অনুমোদন দেয়া হয়। সে অনুযায়ী, শর্ত সাপেক্ষে অর্থ বিভাগ ২২০টি পদের বিপরীতে বেতনগ্রেড নির্ধারণ করে দেয়।

২২০ জনের মধ্যে যারা রয়েছেন, একজন কমিশনার, দুজন অতিরিক্ত কমিশনার, দুজন যুগ্ম কমিশনার, তিনজন উপকমিশনার, সাতজন সহকারী কমিশনার, একজন সহকারী প্রোগ্রামার, ১৫ জন রাজস্ব কর্মকর্তা, ১১০টি সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা, তিনজন কম্পিউটার অপারেটর, তিনজন অফিস সুপারিনটেনডেন্ট, দুজন প্রধান সহকারী, একজন সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর, ১১ জন উচ্চমান সহকারী, একজন সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর, আটজন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক, একজন ক্যাশিয়ার, আটজন সাব ইন্সপেক্টর, সাতজন ড্রাইভার, ২৬ জন সিপাই ও আটজন অফিস সহায়ক।

এ বিষয়ে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনার কাজী মোস্তাফিজুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, বন্ডের যে পরিমাণ কাজের চাপ, তাতে আমরা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়মিত ভিজিট ও অডিট করতে পারি না। কারণ একজন বন্ড অফিসার বা এআরও এর অধীনে এক থেকে দেড়শ’ প্রতিষ্ঠান থাকে। তার পক্ষে ফিজিক্যালি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে যাওয়া, পরিদর্শন করা অসম্ভব। কারণ একেকটি প্রতিষ্ঠান একেক জায়গায়। একটি প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে যেতে অন্তত দুই থেকে তিন ঘণ্টা লাগে।

তিনি বলেন, নতুন কমিশনারেট হলে প্রতিষ্ঠান নিয়মিত মনিটরিং ও অডিট হবে। সময়মত অডিট হলে রাজস্ব ফাঁকি এমনিতেই কমে যাবে। আমাদের মূল দুর্বলতা হলো প্রতিষ্ঠান নিয়মিত অডিট করা যাচ্ছে না। কারণ নিয়মিত অডিট করতে গেলে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন দিক দেখতে হয়। প্রতিষ্ঠান কাঁচামাল আমদানি করতেছে, ইন-বন্ড ঠিক মতো হলো কি নাÑতা মনিটরিং করা। পণ্য রপ্তানি করতেছে, রপ্তানি ঠিক মতো হচ্ছে কি নাÑতা মনিটরিং করা। কারণ রপ্তানির জন্য কাস্টম হাউসে ডকুমেন্ট সাবমিট করে অনেকেই কিন্তু বিল অব এন্ট্রি করে। অনেকেই দেখা যায় যে, ওই ডকুমেন্টের আর অ্যাসেসমেন্ট করে না, পেইন্ডিং থেকে যায়। নতুন কমিশনারেট হলে এসব সমস্যা আশা করি থাকবে না।

এ বিষয়ে বিকেএমইএ’র প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘কমিশনারেট দুটি হলে চাপ কমবে, কাজের গতি বাড়বে। কারণ, এত লাইসেন্স হয়েছে যে একটি কমিশনারেট সময়মতো অডিট সম্পন্ন করতে পারে না। আমাদের লোক ও অফিসার-এই দুই দিক থেকে দুর্নীতি কমবে।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০