ইসমাইল আলী: গ্যাস সরবরাহ হ্রাসে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেড়েছে তরল জ্বালানির ব্যবহার। তবে বিশ্ববাজারে ফার্নেস অয়েলের ঊর্ধ্বমুখী দাম ও দেশে ডিজেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে এ খাতের জ্বালানি ব্যয়ে। পাশাপাশি কয়লার দামও আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক বেড়েছে। ফার্নেস অয়েল ও কয়লা আমদানিতে শুল্কারোপ এবং বিদ্যুতের ওপর ছয় শতাংশ অগ্রিম করারোপের প্রভাবও রয়েছে। সব মিলিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছর অস্বাভাবিক লোকসানের সম্মুখীন হয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।
চলতি অর্থবছরও এ ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই পিডিবির লোকসান দাঁড়িয়েছে প্রায় আট হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা। অথচ ২০১৯-২০ অর্থবছরে (পুরো বছরে) সংস্থাটির লোকসান ছিল মাত্র সাত হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উৎপাদন কমিয়ে লোডশেডিং দেয়ার পরও চলতি অর্থবছরে লোকসান অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। তবে লোডশেডিং করা না হলে এ লোকসান কোথায় গিয়ে দাঁড়াত, তা ধারণাই করা যাচ্ছে না। লোকসানের ঘাটতি পূরণে ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধি অথবা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ছাড়া বিকল্প উপায় নেই বলে মনে করছেন তারা।
পিডিবির তথ্যমতে, চলতি অর্থবছর জুলাইয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৫১১ কোটি ২০ লাখ ইউনিট। এজন্য জ্বালানি ব্যয় হয় চার হাজার ৩০৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা। আর জ্বালানিবহির্ভূত (ক্যাপসিটি চার্জ এবং পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়) ব্যয় ছিল দুই হাজার ১০ কোটি ২০ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় হয় ছয় হাজার ৩১৭ কোটি ১০ লাখ টাকা।
এতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়ে ১২ টাকা ৭৪ পয়সা। এ বিদ্যুতের বাল্ক বিক্রয়মূল্য পাঁচ টাকা আট পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে লোকসান হয় সাত টাকা ৬৬ পয়সা। এর সঙ্গে অন্যান্য ব্যয় যোগ করে জুলাইয়ে পিডিবির লোকসান দাঁড়ায় চার হাজার ২৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
এদিকে আগস্টে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৪৯৭ কোটি ২০ লাখ ইউনিট। এতে জ্বালানি ব্যয় হয় পাঁচ হাজার ৫৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা আর জ্বালানিবহির্ভূত ব্যয় ছিল দুই হাজার ৫১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় হয় সাত হাজার ১১১ কোটি ২০ লাখ টাকা। এতে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় দাঁড়ায় ১৪ টাকা ৭৫ পয়সা।
এ বিদ্যুতের বাল্ক মূল্য পাঁচ টাকা আট পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে লোকসান হয় ৯ টাকা ৬৭ পয়সা। অন্যান্য ব্যয় যোগ করে আগস্টে পিডিবির লোকসান দাঁড়ায় চার হাজার ৮৮০ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অর্থাৎ দুই মাসে পিডিবি লোকসান গুনেছে আট হাজার ৮৮৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
পিডিবির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে জানান, আগে পিডিবি বছরে যে পরিমাণ লোকসান গুনত, এখন এক মাসেই তার কাছাকাছি পরিমাণ লোকসান হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরবরাহকৃত গ্যাসের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে বাধ্য হয়ে তেলের কেন্দ্র বেশি চালাতে হচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য অনেক বেড়েছে। অথচ বিদ্যুতের বাল্ক মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব খারিজ করে দেয়া হয়েছে।
তারা আরও জানান, নতুন বেশ কয়েকটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসছে। এতে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। এ কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় চলতি অর্থবছরে আরও বাড়বে। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে চায় না সরকার। আবার অর্থ মন্ত্রণালয়ও চাহিদা অনুযায়ী ভর্তুকি ছাড় করছে না। সব মিলিয়ে পিডিবি আর্থিকভাবে খুবই চাপের মধ্যে আছে।
তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে পিডিবির লোকসান ছিল ১১ হাজার ৫০৯ কোটি ১২ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা অনেকটা বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ হাজার আট কোটি ৩২ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছর সংস্থাটির লোকসান বেড়েছে ১৯ হাজার ৪৯৯ কোটি ২০ লাখ টাকা বা ১৬৯ দশমিক ৪২ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরে পিডিবির সম্ভাব্য লোকসান প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫১ হাজার ৮৫৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, গ্যাসের সরবরাহ কমায় তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামও অনেক বেড়েছে। আবার ফার্নেস অয়েল আমদানির শুল্ক-কর অব্যাহতি তুলে দেয়ায় ব্যয় বেড়েছে। কয়লা আমদানিতেও শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। বাল্ক বিদ্যুৎ মূল্যের ওপর ছয় শতাংশ অগ্রিম কর আরোপ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। তবে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়নি। ফলে লোকসান রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ১২ বছরে এক লাখ ছয় হাজার ১৭৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা লোকসান গুনেছে পিডিবি। এর মধ্যে ২০১০-১১ অর্থবছরে সংস্থাটির লোকসান ছিল চার হাজার ৬২০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৬৯৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। তবে ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৪৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে পিডিবির লোকসান আবার বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৮০৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সাত হাজার ২৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় তিন হাজার ৮৭৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বেড়ে হয় চার হাজার ৪৩৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে লোকসান আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৩১০ কোটি ১৫ লাখ টাকা। পরের দুই অর্থবছরে লোকসান কিছুটা কমে সংস্থাটির। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আট হাজার ১৪১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে সাত হাজার ৪৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা লোকসান গুনে পিডিবি। পরের দুই অর্থবছরে তা ক্রমেই বেড়ে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।