সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: মসলা জাতীয় পণ্য এলাচ। সমুদ্রবন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া ঘোষিত মূল্য ও রাজস্বসহ প্রতি কেজি এলাচের দাম পড়েছে ১ হাজার ২৬৭ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা। কিন্তু বর্তমানে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ এলাকায় পাইকারিতে বিক্রয় হচ্ছে প্রতি কেজি চার হাজার ৫০ টাকায়। মূলত উৎস দেশগুলোয় বৈরী আবহাওয়ার প্রভাবে উৎপাদন কমে যাওয়া, ডলারের দাম বৃদ্ধি এবং অসাধু ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) ব্যবসায়ীদের কারণে মসলা জাতীয় পণ্যের দাম বেড়েছে।
মসলার পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই মাসের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে এলাচের দাম। দুই মাস আগে প্রতি কেজি এলাচের দাম ছিল ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকা। খুচরায় এখন তা বেড়ে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। আর পাইকারিতে কেজিপ্রতি লেনদেন হচ্ছে চার হাজার থেকে চার হাজার ৫০ টাকায়। গত বছরের তুলনায় এলাচের দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশের বেশি। যদিও কোরবানির ঈদের বাকি প্রায় এক মাস, এর মধ্যেই মসলার বাজার ঊর্ধ্বমুখী। বিশেষ করে এলাচের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এছাড়া অন্যান্য মসলার মধ্যে দারচিনি, লবঙ্গ, ধনিয়া, তেজপাতা, শুকনা মরিচ ও হলুদের দামও গত বছরের তুলনায় বাড়তি।
কোরবানির ঈদে মসলার চাহিদা বছরের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি থাকে। তাই কোরবানিকে সামনে রেখে আগেভাগেই বাজারে মসলার দাম বেড়ে গেছে। এলাচের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে আমদানিকারকরা বলছেন, গুয়েতেমালা ও ভারতে এল নিনোর প্রভাবে ব্যাপক ফসল নষ্ট হয়েছে। এসব দেশে এলাচের দাম বেড়েছে। এছাড়া ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি খরচও বেড়ে গেছে। সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ বলছেন, আমদানি করা এলাচ কয়েক হাত বদলের পর খুচরায় এসে দাম আরও বেড়ে যাচ্ছে। আমদানিকারক থেকে নিয়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ী এলাচ মজুত করে বেশি মুনাফা করছেন। তারা আরও জানান, ২০১৮ সালে গুয়েতেমালায় এলাচ উৎপাদন কম হওয়ায় পণ্যটির দাম নিয়ে বাংলাদেশের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। ওই সময় প্রতি কেজি এলাচ ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ৫ হাজার টাকায় গিয়ে ঠেকে। পরের দুই বছর আমদানিকারকরা এলাচ আমদানি কমিয়ে দেন। এরপর থেকে আমদানিকারকরা পণ্যটির আমদানি বাড়তে থাকে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের দশ মাসে (৩০ এপ্রিল পর্যন্ত) ৬৫ জন আমদানিকারক মোট তিন হাজার ৯৫ টন এলাচ আমদানি করেছে। এর ঘোষিত মূল্য ছিল দুই হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা এবং রাজস্ব প্রদান ছিল ১৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ রাজস্বসহ প্রতি কেজি এলাচের দাম পড়েছে ১ হাজার ২৪৮ টাকা। এছাড়া ২০২৩ সালে ৪ হাজার ৬৭৭ টন এলাচ আমদানি করে। আমদানিকারকদের ঘোষিত মূল্য ও রাজস্বসহ প্রতিকেজি এলাচের আমদানি খরচ পড়ে ১ হাজার ২৫৭ টাকা। ২০২২ সালে ১০৪টি প্রতিষ্ঠান রেকর্ড ৬ হাজার ১ টন, ২০২১ সালে ৭০টি প্রতিষ্ঠান ৪ হাজার ৩৯৫, ২০২০ সালে ৬০টি প্রতিষ্ঠান ৩ হাজার ১০১ টন এবং ২০১৯ সালে ৫০টি প্রতিষ্ঠান ৩ হাজার ৬৭১ টন এলাচ আমদানি করে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের তালিক অনুযায়ী, ছোট আকারের এলাচের খুচরা দাম কেজিপ্রতি ৩ হাজার ৮০০ টাকা। এক বছর আগে (গত কোরবানির ঈদ বাজারে) ছিল ১ হাজার ৮০০ টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে বাজারে এলাচের দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশের বেশি। বাজারে বড় আকারের এলাচের দাম আরেকটু বেশি। খুচরা বাজারে বড় আকারের প্রতি কেজি এলাচ সর্বোচ্চ ৪ হাজার ২০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে।
নগরের চকবাজারের বিকে স্টোরের বিকে মজুমদার শেয়ার বিজকে বলেন, দেশের সব ধরনের মসলার চাহিদা মেটানো হয় আমদানি করেই। ডলারের দাম বাড়ার পর থেকে তাই মসলার দামও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে এলাচের দাম। আমরা কেজি চার হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি করছি।
খাতুনগঞ্জ এলাকার এলাচের আমদানিকারক ও পাইকারি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান সাব্বির ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী সৈয়দ সাব্বির আহম্মেদ শেয়ার বিজকে বলেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ এলাচ গুয়েতেমালা থেকে আমদানি হয়। পাশাপাশি ভারত থেকেও আমদানি হয়। গত নভেম্বরে গুয়েতেমালায় প্রতিটন এলাচের বুকিং রেট চিল ১৪ হাজার ডলার, যা এখন হয়েছে ২৩ হাজার ৭৫০ ডলার। আর ভারতের এলাচ ২৬ হাজার ৫০০ ডলার। অর্থাৎ বুকিং রেট ৩০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। আবার প্রতি টন এলাচে শুল্ক দিতে হয় ৫ লাখ টাকা। সব হিসাব করলে দাম ঠিক আছে। বর্তমানে প্রতি কেজি এলাচ ৩ হাজার ৯০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে; যা কিছুদিন আগে চার হাজার ১০০ টাকায় ওঠেছিল। আবার তিন হাজার টাকাও নামছিল। মূলত ভারতে বুকিং রেট বেড়েছে, তাই আমাদের দেশেও দাম বেড়েছে। এ বাজার দামে অস্থিরতা থাকবে। যদিও এটি বিলাস পণ্য। তাই দাম বাড়লেও সাধারণ মানুষের তেমন খরচ বাড়বে না। তবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আমদানি করা সব ধরনের মসলার দাম। তবে বাজার অস্থিতিশীল বলা যাবে না। আমদানি অব্যাহত রয়েছে।
উল্লেখ্য, দেশে প্রতি বছর এলাচের চাহিদা সাড়ে সাত হাজার টন থেকে আট হাজার মেট্রিক টন। আর দেশে আমদানি হওয়া এলাচের বেশিরভাগই আসে গুয়েতেমালা, ভারত ও দুবাই থেকে। এলএমজি, জেবিস, আরএস-জাম্বো, এসএমজি, এসবি ব্র্যান্ড নামে আমদানি হওয়া এসব এলাচের মধ্যে মাঝারি মানের জেবিসি ও এলএমজির চাহিদা বেশি বাজারে।