Print Date & Time : 25 June 2025 Wednesday 2:37 pm

দুই মাস বেতন-ভাতা পান না শ্রমিক-কর্মচারীরা 

শামীম কাদির, জয়পুরহাট : জয়পুরহাট চিনিকল শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বকেয়া থাকলেও এবারের মতো দীর্ঘস্থায়ী পাওনা বেতনের জের আর কখনও দেখা যায়নি। পাঁচ শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারীর প্রায় দুই কোটি টাকা বেতন ভাতা বকেয়া রয়েছে দুই মাস ধরে। ফলে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।
চিনিকলের প্রশাসন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১৯৬১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ২১৭ একর জমির ওপর জয়পুরহাট চিনিকলের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৬৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি এ চিনিকলে প্রথম আখ মাড়াই শুরু হয়। গত মৌসুমে উৎপাদিত সাড়ে সাত কোটি টাকার এক হাজার ৪০০ টন চিনি এবং চার কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকার তিন হাজার ৩০০ টন চিটাগুড় (মোলাসেস) রয়েছে অবিক্রিত। অবিক্রিত থাকার কারণেই শ্রমিক কর্মচারী-কর্মকর্তার বেতন ভাতা বকেয়া রয়েছে।
চিনিকলের শ্রমিক খালাসি রমজান আলী জানান, গত দুই মাস ধরে বেতন না পাওয়ায় তার অবস্থা খুবই দুর্বিষহ। বেতন নাই বলে কখনও চালান রিকশা আবার বন-জঙ্গলের প্রাকৃতিক শাকসবজি তুলে বিক্রি করে তা দিয়েই চলছে সংসার। আরেক শ্রমিক বিদ্যুৎ বিভাগের হেল্পার জাফর আলীও বেতন না পাওয়ায় সংসার চালাতে পরিবারকে না জানিয়ে চালান ব্যাটারিচালিত রিকশা। শুধু জাফর আলী বা রমজান আলীই নন, ওয়ার্কশপ হেলপার সমারু কর্মকার, ইলেকট্রিক মেকানিক প্রশান্ত কুমার, মিল হাউজের ফোরম্যান রফিকউদ্দিনসহ অনেকেই চাকরির ফাঁকে ফাঁকে অথবা চাকরি শেষ করে আবার কেউ কেউ ছুটি নিয়ে বিভিন্ন পেশায় কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন।
দীর্ঘদিন থেকে মিলের কর্তাব্যক্তিরা মিলের উৎপাদিত চিনি ও মোলাসেস বিক্রি করে বেতন নেওয়ার কথা বলে আসছিলেন। এদিকে বাজারে চিনিকলের চিনি ও বেসরকারি বিভিন্ন কোম্পানির চিনির মূল্যের সামঞ্জস্য না থাকায় শ্রমিকদের বেতন ১৬ শতাংশ লোকসানে নিতে হবে। এ কারণে শ্রমিকরা তাদের বেতন না নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল, কর্মবিরতিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে থাকেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মিল কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন খাত থেকে সমন্বয় করে সম্প্রতি এক মাসের বেতন শ্রমিকদের প্রদান করে।
এদিকে মিলের লোকসান ঠেকাতে এবং আয় বৃদ্ধি করতে মিলের অব্যবহƒত অসমতল জমিকে সমতল, পরিত্যক্ত ভবন এবং জঙ্গল পরিষ্কার করে পরীক্ষামূলক প্রকল্প হিসেবে কচু, ড্রাগন, ভিয়েতনাম ওপি হাইব্রিড নারিকেল বাগান এবং মাশরুম চাষ করা হচ্ছে। এতে লোকসান কমাতো দূরের কথা, বোঝা আরও ভারি হচ্ছে বলে একাধিক শ্রমিক জানান।
চিনিকল শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম জানান, এ শিল্পকে রক্ষা করা খুবই কঠিন, যদি বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো প্রকল্প এর সঙ্গে যুক্ত করা না হয়, তবে এ শিল্প আরও খারাপের দিকে যাবে। সাবেক সাধারণ সম্পাদক খুরশীদ আলম জানান, সুগারমিলে তরল সুগার, বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প একটি দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার। কিন্তু এখন আপদকালীন সমস্যা সমাধানে অন্য সেক্টরের মতো চিনি শিল্পেও যদি সরকার ভর্তুকি দেয় তাহলেই এ সমস্যা সমাধান সম্ভব। এছাড়া কম দামে চিনি বিক্রি করেও সমাধান করা যায়। মিল কর্তৃপক্ষ কচু চাষসহ যেসব প্রকল্প হাতে নিয়েছে এখানে শুধু বিক্রির টাকার কথা বলা হচ্ছে, উৎপাদন ব্যয়ের কথা বলা হচ্ছে না।
চিনিকল শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব রুমেল জানান, ৫০০ শ্রমিকের দুই মাসের বেতন-ভাতা বকেয়া রয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকা। শ্রমিকদের এ পাওনা ভর্তুকি দিয়ে হলেও পরিশোধ করা দরকার।
জয়পুরহাট চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা কামাল জানান, বেসরকারি চিনিকলগুলো তরল আমদানি করে চিনি উৎপাদন করে কম দামে বাজারজাত করছে। আর আমাদের উৎপাদন খরচ বেশি পড়ায় কম দামে চিনি বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নির্দিষ্ট সময়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে এসব সমস্যা সমাধানে তরল চিনি, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে। এগুলো হলে আর সমস্যা থাকবে না।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান একেএম দেলোয়ার হোসেন জানান, সবকিছুর দাম বাড়লেও চিনির দাম কমে বর্তমানে ৪০-৪২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে চিনিশিল্প রক্ষার কাজ করা হচ্ছে। এ শিল্পকে লাভজনক করতে হলে চিনির দাম বাড়ানোসহ বেশি বেশি আখ রোপণ করতে হবে। আর মিলে উৎপাদিত চিনি ও মোলাসেস বিক্রি করে বেতন নিতে হবে এবং এ খাতে সরকারের সরাসরি টাকা দেওয়ার কোনো সুযোগ নাই। কোনো ব্যাংকই চিনিকলকে ঋণ দেবে না। তাই যা আছে তা দিয়ে সমন্বয় করে চলতে হবে।